লিখার কোনো আগ্রহই ছিলনা, কি হবে লিখে- গন্ডারের চামড়ার মতো অনুভূতিহীন সমাজ ব্যবস্থাকে কী পরিবর্তন করা সম্ভব? তবুও না লিখে পারলাম না, হয়তো সবচেয়ে প্রিয় আঙিনার দায়বদ্ধতা থেকে….
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ও প্রিয় প্রাঙ্গণ শাহনগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। শুধু তাই নয় এটা এমন এক আবেগের জায়গা যা কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনা হয় না। আমার জীবনের সোনালী দিনগুলো বলতে আমি খুঁজে ফিরি শাহনগর স্কুলে অতিবাহিত সময়কাল যা অন্যকিছুতে এখনো পর্যন্ত আমার মন ভরাতে পারেনি। কিন্তু আজ প্রিয় জায়গাটি ক্ষতবিক্ষত। ব্যক্তি স্বার্থ বা রাজনীতি যেকোনো কারণে হয়তো এমন পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে যা দীর্ঘদিন ধরে ঘাতকব্যাধীর মতো বিস্তার লাভ করে করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে।
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখানে যাঁরা শিক্ষকতা করেছেন তারা অধিকাংশই লাঞ্চিত ও অসম্মানিত হয়েছেন কোনো না কোনো সময়। শিক্ষকতা মহান পেশা কিন্তু এ মহৎ পেশায় নিজেদের সঁপে দিয়ে অপমান ও অসম্মানকে প্রতিনিয়ত আলিঙ্গন করেছেন আমার প্রিয় শিক্ষকগণ। হয়তো পরিবারের দায়বদ্ধতা কিংবা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবে নিরবে নিভৃতে সহ্য করে গেছেন দিনের পর দিন। শারীরিক ক্ষত ওষুধে শুকিয়ে যায় কিন্তু মানসিক ক্ষতর যে যন্ত্রণা তা বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু। আমাদের আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে কিন্তু মানসিকতার উন্নতি ঘটেনি যার দরুন বেড়ে চলেছে অনভিপ্রেত অপ্রত্যাশিত ঘটনাসমূহ।
চেয়ারের ক্ষমতা আমাদের অন্ধ করে দেয়,অতিমাত্রায় ক্ষমতা জাহির করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে পশুত্বকে বরণ করি। এসব আমাদের ভুল, আমাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে কিন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ড ফুলেফেঁপে বটবৃক্ষে পরিণত হয়। কাউকে একক দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা কখনো এ দায় থেকে মুক্তি পাবো না। আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত সিস্টেমের কর্মফল হচ্ছে এ ঘটনা। আমাদের নীতি বাক্যগুলো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ যার প্রায়োগিক কোনো মূল্য নেই। আমাদের নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে দিনের শেষে রাতের বেলায় ভিন্নরূপে নিজেকে ধারণ করি আমরা। একেকটা মুখ যেন একেকটা মুখোশ।
আমরা আর জাহাঙ্গীর স্যারকে ফিরে পাবো না, তাঁর পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতির পূর্ণতা হবে না। জন্ম মৃত্যু আল্লাহর নির্ধারিত কিন্তু স্যারের মৃত্যুর কার্যকারণ নিয়ে নানা প্রশ্ন আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। শিক্ষকের মূল্য একমাত্র প্রকৃত শিক্ষার্থীরাই বুঝবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকরাই আদর্শ। কোনো ছাত্রছাত্রী চাইবে না তার শিক্ষক অপমানিত, লাঞ্চিত হোক।
শাহনগর স্কুলের দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনামের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হতে অনেক সময় লাগবে। হয়তো এখন ঘটনাটি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক জনমত সৃষ্টি হবে।
কিন্তু আমাদের উচিত সব স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে শুধু শাহনগর স্কুলকে বাঁচানো। অন্তত ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে প্রিয় বিদ্যাপীঠকে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখি। সুনাম অর্জন করা কঠিন কিন্তু একটু ভুলে তা নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। শেকসপিয়ারের একটি উক্তি আছে – সে আমার সুনাম কেড়ে নিয়েছে,কেড়ে নেয়া সেই সুনাম তাকে সমৃদ্ধ করেনি কিন্তু আমাকে নিঃস্ব বানিয়ে ছেড়েছে। তাই স্কুলের ঐতিহ্য ও সুনাম ধরে রাখতে আমাদেরকে কৌশলী হতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জ্ঞানের বাতিঘর, এখানে জ্ঞানের চর্চা হবে। ব্যবস্থাপনায় যারা থাকবেন তাদেরকেও সুশিক্ষিত ও জ্ঞান পিপাসু হতে হবে। মুখে জয়,মুখে ক্ষয়। ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। তাইতো বলে ব্যবহারে বংশের পরিচয়। মনে রাখতে হবে শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে না পারলে কখনো সুশিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হবেনা। শিক্ষকের মর্যাদা কিভাবে দেবেন সম্রাট আলমগীরের দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করার অনুরোধ করছি। টাকার সাথে যদি শিক্ষার পরিমাপ করা হয় তাহলে সেখানে বিদ্যার চর্চা হবে এমন প্রত্যাশা করাটা বোকামি। শাহনগর স্কুলের সমৃদ্ধ একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাঁরা দেশে- বিদেশে স্ব স্ব অবস্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমার বিশ্বাস মন থেকে চাইলে শাহনগর স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। সংঘাত নয়, যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তার নিশ্চয়তাই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে আপোষহীন থাকতে হবে।