রেলের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী হোসাইনের ৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অঢেল সম্পদ

চট্টগ্রাম রেলওয়ের জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ শিপিং কার্যালয়ের ম্যাটারিয়াল চেকার (এমসি) মোহাম্মদ হোসাইন সরকারি চাকরি বিধি অমান্য করে চালিয়ে যাচ্ছেন ৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নিরীহ লোকজনকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করে হাতানো টাকায় বানিয়েছেন অঢেল সম্পদ, ব্যাংক ব্যালেন্স ও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার পাহাড়।


সম্প্রতি চাকরির প্রলোভনে মো. হোসাইনকে টাকা দিয়ে প্রতারণা শিকার ও প্রাণ নাশের হুমকিতে থাকা মো. সিরাজুল ইসলাম, নূর আলম ও মো. আব্দুর রাজ্জাক সুমন নামে তিন যুবক অভিযোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা ব্যবস্থাপক (জিএম) বরাবরে। একইভাবে হোসাইনের প্রতারণা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রামের উপপরিচালক বরাবরেও।

অভিযোগের পর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদ হোসাইন চাকরি বিকিকিনি করেই ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরের ‘আলকরণ এলাকায় চারগন্ডা জমিসহ পাঁচতলা একটি ভবন’ ক্রয় করেছেন। যার বাজার মূল্য আড়াই কোটি টাকা।

আমির এন্ট্রারপ্রাইজ” নামে নগরের কোতোয়ালী থানাধীন ৯২, স্টেশন রোডের মহিউদ্দিন মাকের্টের নীচ তলায়, রিয়াজউদ্দিন বাজারের আরএস রোডের আনন্দবিতানে ১৫১/১ ও আগ্রাবাদ চৌমুহুনীর কর্ণফুলী মার্কেটের ২৫৯ নম্বর সিরিয়ালে চারটি দোকান গড়ে তুলেছেন তিনি। একইভাবে ৫/৬, সদরঘাট রোডে ‘আমিন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, বিটিএল লুব্রিকেন্টস্ ও ঈগলু আইসক্রিমের’ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ডিলারশীপ নিয়ে গড়েছেন আরও কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এডভোকেট মুহাম্মদ মহসীন বলেন, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

রেলওয়ের জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক শিপিং (পূর্ব) এর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জানিয়েছেন,
সরকারী এই চাকরি বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে একে একে সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মো. হোসাইন। যার কারণে তিনি প্রায় সময় অফিসে উপস্থিত থাকেন না। তার স্ত্রীও রেলের চাকরিজীবী। তিনিও স্বামীর ব্যবসা বাণিজ্য দেখা শুনা করছেন।

এই বিষয়ে মোহাম্মদ হোসাইনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার মতো রেলে চাকরি করে শতাধিক লোক ব্যবসা বাণিজ্য করছে। আমার ৭ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান আছে সেটা ঠিক, ২৫ হাজার টাকার বেতনে চলে না। শহরে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া করে বেঁচে থাকা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়ে সচল ভাবে জীবন-যাপন করছি।

প্রতারণার অভিযোগ :

রেলে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে হোসাইনের বিরুদ্ধে। তাঁকে বিশ্বাস করে নিঃস্ব হয়েছেন চাকরি প্রত্যাশি বেশকিছু বেকার যুবক। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) কাছে দেওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগে বলা হয়েছে পঞ্চগড়ের মো. নূর আলমকে ৭ লাখ টাকায় “পোর্টার” পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মৌখিক চুক্তি করেন হোসাইন। এরমধ্যে তাঁকে নগদ প্রদান করা হয় ৪ লাখ টাকা। বাকি টাকা চাকরির নিয়োগপত্র বুঝে পেলেই দেওয়ার কথা ছিল।

নুরুল আলম বলেন, নগদ চার লাখ টাকার বিপরীতে জামানত হিসেবে মো. হোসাইন আমাকে দুই লাখ করে দুই চেকে মোট ৪ লাখ টাকার চেক প্রদান করেন। তবে টাকা ও চেক নেওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও চাকরি না দেওয়ায় প্রদানকৃত টাকা ফেরত চায়। পরে গত ১৮ রমজান সেই টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে আমাকে নগরের আলকরণে উত্তরা ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী একটি অফিসে ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে  জিম্মি করে চার লাখ টাকার চেক ছিনিয়ে নেয়। এ সময় আমি টাকা বুঝে পেয়েছি অস্ত্রধরে এমন অভিনয় করতে বাধ্য করে তারা। আর সেই দৃশ্য দুই সন্ত্রাসীকে দিয়ে নিজেদের মোবাইলে ভিডিও ধারণ করান মো. হোসাইন।

কান্না জড়িত কন্ঠে নূর আলম বলেন, দুইটি চেক কেড়ে নিয়ে তা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে সন্ত্রাসীরা আমি ও আমার চাচা আব্দুল কাদেরের মুখের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই বিষয়ে কোথাও কাউকে কিছু না বলার জন্য তারা সেই সময় আমাদের ভয় দেখায়।

অপর অভিযোগকারী মো. সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ উল্লেখ করেন, ‘অফিস সহকারী’ পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৯ লাখ টাকা কন্টাক্ট করেন হোসাইন। এরমধ্যে হোসাইন তিন লাখ টাকা নগদ এবং ৬ লাখ টাকার একটি চেক নেন। আর আমার নগদ তিন লক্ষ টাকার বিপরীতে মো. হোসাইনকে আইএফআইসি ব্যাংকের হিসাবের একটি চেক প্রদান করি। শেষ পর্যন্ত চাকরিতো পেলাম না, টাকাও হাওয়া হয়ে গেল।

মো. আব্দুর রাজ্জাক নামের বান্দরবানের লামার এক যুবক অভিযোগে উল্লেখ করেন, গেইট কিপার পদে চাকরির জন্য ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকায় তাঁর সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করেন মো. হোসাইন। এরমধ্যে প্রথমে নগদ দেড় লাখ টাকা নেন। বাকি ২ লক্ষ ২০ হাজার চাকরির নিয়োগপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার সময় প্রদানের শর্তে আব্দুর রাজ্জাকের বড়ভাই আব্দুল কাদেররের একটি চেক লিখিয়ে নেন। হোসাইন বর্তমানে সেই টাকাও অস্বীকার করে চলেছেন।

শুধু নূর আলম, সিরাজুল ইসলাম বা আব্দুর রাজ্জাকই নয়, চাকরি দেওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এক যুবকের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নেন হোসাইন। ১৬ লক্ষ টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ায় নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজার ব্যবসায়ী সমিতিতে একটি অভিযোগ বিচারাধীন।

এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদের বলেন, মো. হোসাইন যদি চাকরি প্রত্যাশি কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।