ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে কক্সবাজার সাগর তীরের মানুষ। সন্ধ্যা ৬টায় জেলা প্রশাসনের ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসেব মতে, প্রায় দুইলাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য লোকজনকে রাতের মধ্যেই নিরাপদে সরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আবহাওয়া বিভাগ ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০নং বিপদ সংকেত জারি করেছে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৩ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ। তিনি বলেন, এরই মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। যাদের সঙ্গে এসেছে গবাদি পশুও। স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকিং করে সাধারণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হচ্ছে। রাতের মধ্যেই আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা দুই লাখে পৌঁছে যাবে। বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, এরই মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রায় সব মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দ্বীপের ৪ হাজার ৩০৩ জন বাসিন্দা মোট ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।

আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, ইতোমধ্যে দুর্যোগের আশংকায় জেলার সব নৌপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ চলাচলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে শুক্রবার রাত ১১টা থেকে মহেশখালীর দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সব হোটেল–মোটেল ও রিসোর্টকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন থেকে কয়েক হাজার মানুষ ট্রলারে করে টেকনাফে চলে এসেছে। যারা আসতে পারেননি তাদের স্থানীয় হোটেল রিসোর্ট এবং নৌবাহিনীর কোস্ট গার্ডের স্থাপনায় আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। তবে গতরাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। উপকূলে কিছুটা পানি বাড়লেও সাগর এখনও উত্তাল হয়ে উঠেনি। শুক্রবার বিকেলের বৃষ্টির পর থেকে কক্সবাজারে গরম কমেছে। শনিবার সারাদিন থেমে থেমে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আকাশ মেঘলা রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো প্রভাব দেখা না যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়নি।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষন কান্তি দাশ জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় দুর্যোগকালীন আশ্রয়দানের জন্য কক্সবাজারে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬২০টি তে উন্নীত করা হয়েছে। এতে জেলার ৬ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। এছাড়া শহরের ৬৮টি হোটেল মোটেলকেও আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এ জন্য প্রায় ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান জানান, কক্সবাজার শহরে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সমুদ্র সৈকতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বিচকর্মীরা কাজ করছে। এছাড়া শুক্রবার রাত থেকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার জন্য মাইকিং করছে।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা নয়ন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে অবস্থিত ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব শিবিরে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

এদিকে ১০নং সতর্কতা সংকেত জারির পর সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করে সকল ট্রলার ঘাটে ফিরে এসেছে বলে জানান কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। তিনি জানান, গত রাতে কক্সবাজারের প্রায় শতভাগ ট্রলার ঘাটে ফিরে এসেছে এবং নিরাপদ পোতাশ্রয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজারে প্রায় ৭ হাজার ফিশিং বোট রয়েছে।

টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, ১০নং মহা বিপদ সংকেত জারির পর থেকে সেন্টমার্টিনের লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে আসা শুরু করেছেন। গতকাল শনিবার রাত ৮টার সময় কথা হয় সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এই মুহূর্তে দ্বীপের ভলান্টিয়ার ও জরুরি কাজে নিয়োজিত দায়িত্বশীল ছাড়া সকলেই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এখনো দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় মোখার বড় ধরনের প্রভাব শুরু হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আতংক পরিলক্ষিত হচ্ছে।

টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ১০নং মহাবিপদ সংকেত জারির পর সেন্টমার্টিন দ্বীপের কিছু লোকজন কান্নাকাটি শুরু করেছেন বলে টেলিফোনে একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জেনেছি। তবে এ মুহূর্তে কোনো ধরনের ট্রলার পাঠানো সম্ভব নয়।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা আরজিনা বেগম নামের এক নারী বলেন, যদি ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়, তখন তো কেউ কারো খবর নিতে পারবে না। তাই সময় থাকতেই আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসলাম। চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, লোকজন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।