আসছে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট

 

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান নিশ্চিত ও “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার প্রয়াসে গুরুত্ব দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেটে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও গুরুত্ব পাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানানা, ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেটের আকার মূলত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিপথ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্যই করা হচ্ছে।

এ বাজেটকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বা সম্প্রসারণমূলক করা হবে না বলেও জানান তিনি।

অর্থমন্ত্রীর এ বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হতে যাচ্ছে, “উন্নয়নের দেড় দশক: স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে”।

বাজেট বক্তৃতায় ১১টি অধ্যায় থাকবে। অর্থমন্ত্রী পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বাজেট বক্তৃতা শুরু ও শেষ করবেন।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এমন এক সময়ে এ বাজেট পেশ করা হবে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতির সহ্য করতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনগণকে ব্যাপক দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসন্ন বাজেট বক্তৃতায় “স্মার্ট বাংলাদেশের” বিষয়ে রূপরেখাও তুলে ধরা হবে।

সরকার আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৭.৫% প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের পরিকল্পনা করছে। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতির হার ৬.৫% এর কাছাকাছি রাখতে চাইছে।

আগামী বছরে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হবে জিডিপির ৩৩.৮%।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২২-২৩) জিডিপি ৬.০৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮.৪%।

বাজেট বক্তৃতায় ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানো হবে।

এতে আইসিটি খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং স্মার্ট সিটিজেন তৈরির দিকে নজর দেওয়া হবে। এ বাজেট আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২.৩৪% বড় হবে।

এটি হবে ৫০ লাখ ৬,৬৮২ কোটি টাকার, যা প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫.২১%। বর্তমান অর্থবছরে এটি ছিল ১৫.২৭%। ফলে বিশ্লেষকদের মতে, আগামী বাজেট উচ্চাভিলাষী নয়।

কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারের সম্ভাব্য রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে প্রায় ৬৭,০০০ কোটি টাকা বেশি।

সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআরকে ৪.৩০ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতে পারে। এরমধ্যে এনবিআর-বহির্ভূত উত্স থেকে ২০,০০০ কোটি টাকা আসতে পারে। এছাড়া বাজেটে কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

সরকার ইতিমধ্যেই আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য ২.৬৩ লাখ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে। যার মধ্যে ১.৬৯ লক্ষ কোটি টাকা (৬৪.২৬%) স্থানীয় উত্স থেকে আসবে। বাকি ৯৪,০০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৫.৭৪% আসবে বিদেশী উৎস থেকে।

স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনের বরাদ্দ বিবেচনায়, আগামী অর্থবছরে সার্বিক আনুমানিক উন্নয়ন ব্যয় দাঁড়াবে ২,৭৭,৫৮২ কোটি টাকা।

প্রধান ব্যয়ের মধ্যে, ৪,৮৪,২০৩ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় হিসাবে রাখা হবে। যার মধ্যে ৯৪,৩৭৮ কোটি টাকা সুদ পরিশোধে। ৮০,০০০ কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ব্যয় বহনের জন্য। ভর্তুকির জন্য ১.১০ লাখ কোটি টাকা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ১,২৬,২৭২ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, অনুদান হিসেবে ৩,০০০ কোটি টাকার পাশাপাশি নিট বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ১,২৭,০১৯ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। বিদায়ী অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫,৪৫৮ কোটি টাকা।

অর্থায়ন ঘাটতি মেটাতে সরকার আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ১,৩২,৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেবে। যার অধিকাংশই হবে স্বল্পমেয়াদী ঋণ।

এ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ২৩ হাজার কোটি টাকা। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নিম্নমুখী প্রবণতা থাকায় এই লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে।

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সামগ্রিক আকার ৫০,০৬,৬৭২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ৪৪,৪৯,৯৫৯ কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি হতে পারে ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.২%।

ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১,৫০,৭৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১,৩২,৩৯৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী উৎস থেকে ১,১০,৭৮৫ কোটি টাকা।

ভর্তুকির জন্য ১.১০ লাখ কোটি টাকার উচ্চতর বরাদ্দ করা হবে। সুদ দেওয়ার জন্য ১.০২ লাখ কোটি টাকা দেওয়া হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধের জন্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্য এবং টাকার অবমূল্যায়নের ধাক্কা সহনীয় করতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বৈদেশিক রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে সরকার আগামী অর্থবছরেও কঠোরতা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে পারে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে সারাদেশে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এজেন্টরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে জনগণকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে রাজি করাবেন। তারা জনগণকে ট্যাক্স ফাইল খুলতে ও রিটার্ন জমা দিতে সাহায্য করবেন। তবে এজেন্টরা কর আদায় করবেন না।

যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে ও করযোগ্য আয়সীমার নিচে তাদের রিটার্ন জমা দিতে হবে ও ন্যূনতম ২,০০০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে।

করযোগ্য আয়ের সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৫০ লাখ টাকা করা হতে পারে। করযোগ্য আয়ের উপর ন্যূনতম কর ৫,০০০ টাকা একই থাকবে।

কর্মকর্তা বলেন, করযোগ্য আয় নেই এমন লোকদের তাদের টিআইএন বাতিল করার বিকল্প থাকবে।

প্রায় ৮.৮ মিলিয়ন টিআইএন-ধারক আছে, কিন্তু মাত্র তিন মিলিয়ন তাদের রিটার্ন জমা দেয়। যারা রিটার্ন জমা দেন তাদের অনেকেই কর দেন না। কারণ তাদের আয় করযোগ্য নয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, তারা রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য আরও ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) ইনস্টল করবেন।

আগামী তিন বছরে তিন লাখ ইএফডি স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৯,০০০ ইএফডি চালু আছে।

বাজেটে সরকারের ব্যয় মেটাতে রাজস্বের উৎস হিসেবে আয়করের ওপরও জোর দেওয়া হবে। এছাড়াও এনবিআর বহির্ভূত উৎসের আয় বাড়াতে সব ক্ষেত্রে সরকারি ফি বাড়ানো হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কথাও ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী।