রাজনীতি থেকে ‘শিগগিরই’ অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিএনপির গুরুত্বহীন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে দাবি করি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছি। কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এখন জড়িত নই। শারীরিক কারণে শিগগির রাজনীতি থেকে অবসর নেব। ৩১ বছরের রাজনীতি করে এই দল থেকেই বিদায় নিতে চাই।’
বুধবার (৮ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর বনানীর নিজ বাসায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
‘দল ভেঙে নতুন দল করছেন এবং নির্বাচনে যাচ্ছেন’ হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে যখন এ ধরনের গুঞ্জন তুঙ্গে তখন এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুললেন দলটির এই ভাইস চেয়ারম্যান। রাজনীতি থেকে বিদায়ের ইঙ্গিত দিয়ে নিজ দলের কড়া সমালোচনায় মুখর হলেন তিনি। পদ-পদবির জন্য রাজনীতি করেন না দাবি করলেও দলে পদোন্নতি না পাওয়ায় ক্ষোভও প্রকাশ করলেন বিএনপির এই নেতা।
দলে পদোন্নতি না পাওয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২৩ বছর আমি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। ড. মোশাররফ ও রফিকুল ইসলাম মিয়া ছাড়া সবাই আমার জুনিয়র। কিন্তু আমি ছাড়া সবাই উপরে উঠে গেছে। আমি পদবির জন্য রাজনীতি করি না। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে যোগদান করেছি।’
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জুনিয়র নেতারা সিনিয়র পদ-পদবি পেলেও কোনো অভিযোগ নেই। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিস্ক্রিয় আছি। রাজনীতিতে এখন কোনো আগ্রহ নেই।’
দলের বিরুদ্ধে নিজের খেদের কথা জানিয়ে মেজর হাফিজ বলেন, ‘২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় আজগুবি ১১টি অভিযোগে। সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে অংশ না নিলেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। তিন বছর পার হলেও নোটিশের উত্তরের কোনো পাল্টা জবাব পাইনি। ৩১ বছর রাজনীতি করে এমন প্রাপ্তি পীড়াদায়ক।’
দলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘অনেক ভুল আমরা করেছি। দলীয়ভাবে বলার সুযোগ নেই। আট বছর কোনো কাউন্সিল হচ্ছে না। জাতির স্বার্থে কিছু কথা বলতে হয়। দলের সব নেতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কথা বলা। বিএনপিতে একটি সত্যি কথা বলা লোক চোখে পড়েনি সাইফুর রহমান (সাবেক অর্থমন্ত্রী) ছাড়া। সবাই ‘ইয়েস স্যার, রাইট স্যার’ বলা লোক।’
আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে শারীরিক কারণে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। জনগণের সাথে কথা বলে রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার চেষ্টা করব।’
মেজর হাফিজ বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কেয়ারটেকারের কথা না ভেবে বিকল্প ভাবা উচিত। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ের সক্ষমতা লাগে, তা নেই বিএনপির। দলের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দুর্বল।’
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। জনগণ সুযোগ পেলে সঠিক বিচার করে। ক্ষমতাসীনরা মনে করে, উন্নয়ন কাজে ভোট পাবে। আসলে মানুষ বিচার করে নিত্যপণ্যের দাম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়। শুধু উন্নয়ন কাজে ভোট হয় না।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘অনুগ্রহ করে সামাজিক সম্প্রীতির দিকে লক্ষ্য রেখে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করুন। কারণ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না।’
পাশের দেশ ভারত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে। শক্ত ভিত্তির ওপর তাদের গণতন্ত্র। তাদের অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বিএনপির ও অন্যান্য দলের সঙ্গে বসে সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের অবস্থা খারাপ হলে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দায়ী থাকবে।’
হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারী আমলাদের পাচার করা টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানান বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে হাফিজ বলেন, ‘দলে সংস্কার করতে হবে। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে।’ কেন দলের মধ্যে একনায়কত্ব হচ্ছে, কেন পদ-বাণিজ্য হচ্ছে, প্রশ্ন রাখেন এই নেতা।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন ‘জেড’ ফোর্সে ছিলেন হাফিজ উদ্দিন। যুদ্ধে সাহসিকতার জন্যে তিনি বীরবিক্রম খেতাব পান। সামরিক বাহিনী থেকে অবসরের পর তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে দুইবার জাতীয় পার্টি, একবার স্বতন্ত্র এবং তিনবার বিএনপি থেকে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তিনি। সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে কারাগারও যেতে হয়েছে তাকে।
দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ায় ২০২০ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দল ভেঙে নতুন বিএনপি গড়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।