ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ফের আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল পরিষদের অন্যতম অস্থায়ী সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সেই প্রস্তাবে উপত্যকায় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি দু’টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিল আমিরাত— (১) আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সব বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং (২) শিগগির এবং শর্তহীনভাবে সব জিম্মিকে মুক্ত করতে হবে।
শুক্রবার পরিষদের বৈঠকে প্রস্তাবটি পেশ করার পর সেটি গৃহীত হয় এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ভোটের জন্য উত্থাপন করা হয়। ভোটে পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ১৫ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৩টিই এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
বাদ ছিল কেবল দুই স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ভোটদান থেকে বিরত থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি বা ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
জাতিসংঘের যুক্তরাষ্ট্র মিশনের উপ রাষ্ট্রদূত রবার্ট উড নিজ বক্তব্যে সরাসরি বলেন, ‘এই প্রস্তাব বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন এবং এর মাধ্যমে আসলে গঠনমূলকভাবে সেখানে বিদ্যমান সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।’
‘আমরা এখন, এই পরিস্থিতিতে এমন কোনো অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি আর সমর্থন করতে পারি না— যা আসলে সেখানে পরবর্তী যুদ্ধের বীজ রোপন করবে।’
জাতিসংঘের যুক্তরাজ্য মিশনের প্রধান ও রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমিরাতের প্রস্তাবে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের হামলার বিরুদ্ধে নিন্দা না জানানোয় সেটির পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল যুক্তরাজ্য।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালানোর পর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। পরে ১৬ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
ইসরায়েলি বাহিনীর টানা দেড় মাসের অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ১৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। নিহত এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি।
অন্যদিকে, হামাস যোদ্ধাদের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। পাশাপাশি, ইসরায়েলের ভূখণ্ড থেকে ২৪২ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল হামাস যোদ্ধারা।
দেড় মাসেরও বেশি সময় যুদ্ধের পর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করে গত ২৫ নভেম্বর অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এবং হামাস। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি যুদ্ধের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের মাধ্যমে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বরাবর একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল হামাসের হাইকমান্ড।
সেই প্রস্তাবে গোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল যদি গাজা উপত্যকায় চার দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, রাফাহ ক্রসিংয়ে অপেক্ষারত ত্রাণ, জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে প্রবেশ করতে দেয় এবং ইসরায়েলি কারাগারগুলো থেকে অন্তত ১৫০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয়, তাহলে নিজেদের হাতে থাকা জিম্মিদের মধ্যে থেকে ৫০ জনকে ছেড়ে দেবে হামাস।
সেই প্রস্তাব মেনে নিয়ে ২৫ নভেম্বর চার দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। পরে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর, ইউরোপ ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের তৎপরতায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আরও তিন দিন বাড়ানো হয়।
যুদ্ধবিরতির ৭ দিন ২৫-৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৪ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। বিপরীতে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগার থেকে ১৮০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে ইসরায়েলও।
১ ডিসেম্বর ভোর থেকে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি। ইসরায়েলি হামলায় গত ৮ দিনে গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে আড়াই হাজারের বেশি এবং হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা এখনও অজনা।
এদিকে দুই স্থায়ী রাষ্ট্রের অসহযোগিতার জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ভেস্তে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুন্ন হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। জাতিসংঘে দেশটির মিশনের অন্যতম কর্মকর্তা এবং উপ রাষ্ট্রদূত মোহামেদ আবু শাহাব ভোটাভুটির পর পরিষদের সভায় বলেন, ‘গাজায় বিরতিহীন বোমাবর্ষণ বন্ধে আমরা একমত হতে পারছি না; এর মাধ্যমে আমরা আসলে ফিলিস্তিনিদের কী বার্তা দিচ্ছি?’
‘শুধু ফিলিস্তিন নয়, বিশ্বের অন্যান্য যেসব প্রান্তে সংঘাত চলছে— সেখানকার জনগণ কী বার্তা পেলো আমাদের আজকের এই সভা থেকে?’
প্রসঙ্গত, গত ১৭ অক্টোবর প্রথমবারের মতো গাজায় যুদ্ধবিরতের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল রাশিয়া। সেবারও ভোটাভুটির সময় সেই প্রস্তাবে ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।