নিজস্ব প্রতিবেদক :: চট্টগ্রামের ৫ম বৃহত্তম উপজেলা বাঁশখালী।এই উপজেলার আয়তন ৩৯২ বর্গকিলোমিটার।১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজেলাকে প্রকৃতি সাজিয়ে দিয়েছে তরে তরে।পূর্বে পাহাড় আর পশ্চিমে বিশাল জলরাশির বঙ্গোপসাগর,দক্ষিণে পেকুয়া ও পূর্বে নাতি উচ্চ শিলা সংলগ্ন সাতকানিয়া।বাঁশখালীর ভূ-ভাগ চিরে উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত স্রোতধারা উত্তর শঙ্খ নদী হতে দক্ষিণ অভিমুখে কখনো কুমারি ছড়া,কোথাও ফাঁড়ি খাল কোথাও বা গর্দভী নদী আবার কখনো জলকদর নামে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন কুতুবদিয়া প্রণালিতে গিয়ে মিশেছে।৩৯২ কিলোমিটারের বাঁশখালী যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের বেষ্টনি!এই জনপদের সাথে সুদূর অতীতে স্থলপথে যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে।প্রান্তিক জনপদ বাঁশখালীতে রয়েছে ইকোপার্ক,নাপোড়া অর্গানিক ইকো ভিলেজ(তারেক পার্ক),চাঁ-বাগান,৩২কিলোমিটারের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত,ঐতিহাসিক কাতেবী জামে মসজিদ,খালেদার টিলা,বখশী হামিদ মসজিদ,মলকা বানুর দীঘি ও মসজিদ,বদল মুন্সী মসজিদ,ঝাউবাগান,লিচু বাগান,শুঁটকি চাতাল,জমিদার মনুমিয়াজীর বাসভবন ও মনুমিয়াজী মসজিদ,লবণ মাঠ,কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র,পাথরঘাটা সমুদ্র সৈকত আরো কত কি!
নিম্ন আয়ের মানুষজন বিনোদনের খোরাক জোগাতে কক্সবাজার বিকল্প হিসেবে বাঁশখালীকে বেছে নেন।কারণ,বাঁশখালীতে কম খরচে অনেক কিছু অবলোকন করা যায়।প্রতিনিয়ত বাঁশখালী পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকে মুখর থাকে।
ইকোপার্ক:এটি বাঁশখালীর শীলকূপ ইউনিয়নে প্রায় ১০০০হাজার হেক্টর বনভূমির সমন্বয়ে গঠিত।এই পার্কে রয়েছে পর্যটকদের নজর কাড়ার মত জীব-জন্তু,পাখি,বৃক্ষ,ঝুলন্ত সেতু,সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার,ডানের ছড়া ও বামের ছড়া লেক।এই পার্কের প্রধান আকর্ষণ বাংলাদেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু।কাঠের পাটাতনে নির্মিত সেতুটির দৈর্ঘ্য ১২২মিটার বা ৪০০ ফুট।এই সেতুটি ৩০জন মানুষের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন।তাছাড়া এই পার্কে রয়েছে ৮৫ প্রজাতির পাখি,৪৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী,২৫ প্রজাতির সরীসৃপ,৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী।১৯৯৭ সালের জরীপ মতে,এই পার্কে আছে ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ।যার মধ্যে ১৮ প্রজাতির দীর্ঘ বৃক্ষ,১২ প্রজাতির মাঝারি বৃক্ষ,১৬ প্রজাতির অর্কিড,ইপিফাইট ও ঘাস জাতীয় গাছ।তাছাড়া এই পার্কে প্যানোরমিক ভিউ টাওয়ার রয়েছে।এই টাওয়ারের উপরে ওঠে পার্কের সমস্ত দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতও দেখা যাবে এই টাওয়ারের মাধ্যমে।
সমুদ্র সৈকত: বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় কক্সবাজার।এই সৈকতের দীর্ঘ ৩২ কি.মি।সমুদ্র সৈকতে রয়েছে সারি সারি ঝাউ গাছ।প্রতিনিয়ত বাঁশখালীসহ চট্টগ্রামের আশেপাশের লোকজন কক্সবাজারের স্বাদ নিতে যায়।পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে পর্যটকের ভীড় জমে।জমে ওঠে সেলফি আড্ডা।শিগগিরই পর্যটন মন্ত্রণালয় এই সৈকতকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা করবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
নাপোড়া অর্গানিক ইকো ভিলেজ:বাঁশখালীর নাপোড়া গ্রামে অবস্থিত এই পার্কটি।এটিকে অনেকে তারেক পার্ক নামে চেনে।বাঁশখালীকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে এই পার্কটি প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাষ্টার নজির আহমদের কনিষ্ঠ পূত্র জনাব তারেক রহমান।প্রায় ১২ কানি জমি জুড়ে পার্ককে সুনিপুণ কারিগরদের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে।আছে ময়ুর-ময়ুরী,উটপাখি ও বাজপাখিসহ নানা প্রজাতির পাখি।মাটি,কাঠ,বেত,রশি ও পরিত্যক্ত যানবাহনের টায়ার দিয়ে তৈরী হয়েছে বিশ্রাম হাউজ,রেষ্টুরেন্ট,রান্নাঘর,শয়নকক্ষ,দোলনা ও শৌচাগারসহ নানা স্থাপনা। বিনা টিকেটে বিনা পঁয়সায় এই পার্কে বেড়ানো যায়।বর্তমানে এই পার্ককে আরো আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
খালেদার টিলা:এটি বাঁশখালীর কাথরিয়া ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামে।জানা যায়,প্রাকৃতিক দূর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁশখালী উপকূলের জানমাল রক্ষায় একটি টিলা স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।ঘূর্ণিঝড়ের খবর প্রচারিত হলে বাঁশখালীর মানুষ এই টিলায় অবস্থান নেয়।লোকমুখে এই টিলা “খালেদার টিলা” নামে প্রচার হয়।পর্যটকদের নজর কাড়ছে খালেদার টিলা।
ছনুয়া কাতেবী জামে মসজিদ:বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের কাতেব পাড়ায় হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য কাতেবী জামে মসজিদের অবস্থান।কাতেব আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত ছোট-বড় মোট ২১ গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ।যে মসজিদে হিন্দু-মুসলমানসহ প্রায় ধর্মালম্বীর মানুষ যায় মানত করতে।এই মসজিদে গায়েবী আজান হয় বলে কথিত আছে।তাই এটিকে অনেকে গায়েবী মসজিদ নামেও চিনে।এই মসজিদে মানত করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় বলে কথিত আছে।বাঁশখালীর কৃতি সন্তান প্রফেসর ইমেরিটার্স ড. আবদুল করিমের “বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য” গ্রন্থ্যে উল্লেখ করেন,কোন লোক এই মসজিদে ঢুকে সত্য লুকায়িত করে যদি মিথ্যা শপথ করে;সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি মৃত্যু কিংবা অন্য কোন বিপদের সম্মুখীন হবেন।
চাঁনপুর-বৈলগাও চা বাগান:বাঁশখালীর প্রবেশদ্বার পুকুরিয়া ইউনিয়নের চাঁনপুর-বৈলগাঁও নামক দুটি গ্রাম জুড়ে বিস্তৃত এই চা বাগান।দেশে ক্লোন চা উৎপাদনে সিলেটের পরেই এর অবস্থান।এই চা বাগানের আয়তন ৪৭৭২ একর।দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপে তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হয়।দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে বাঁশখালীর ঐতিহ্যবাহী এই চা বাগান।প্রতিদিন প্রকৃতির ডাকে এই চা বাগানে ছুটে আসে পর্যটকরা।এই চা বাগানে প্রায় ১৫শ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।
আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন গরীবের কক্সবাজার খ্যাত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাঁশখালীতে।
যেভাবে যাবেন:চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল কিংবা নতুন ব্রীজ থেকে বাসে করে মাত্র ৩০টাকা ভাড়ায় যেতে পারবেন বাঁশখালীর চাঁনপুর-বৈলগাঁও চা বাগানে।এই চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর মাত্র ৪০টাকায় লোকাল সিএনজিতে করে যাবেন বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে।বাঁশখালী সমুদ্র চরে বেড়ানোর পর যাবেন বাংলাদেশের ঝুলন্ত সেতু দেখতে বাঁশখালী ইকোপার্কে।একদিনের সময় নিয়ে যাবেন।একদিনেই পুরো বাঁশখালীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবেন।