তসলিম উদ্দীন রানা

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক একজন খাটি বাঙালী

 

বাঙালী জাতি সত্ত্বার আসল ঠিকানা যিনি রেখে দিয়ে গেছেন তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন বাংলার হক সাহেব। শিক্ষাদীক্ষায়, চালচলনে ও দেশপ্রেমিক এক অনন্যা উচ্চতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের নিকট তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত।তার নাম শুনলে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখত। সবাই এক নামে তাকে হক সাহেব বলত।অসম্ভব পান্ডিত্যের অধিকারী হয়ে মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অনস্বীকার্য ও অতুলনীয়।

 

বাংলার বাঘ খ্যাত বাংলার মুকুটহীন সম্রাট শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, একটি অবিস্মরণীয় নাম, এক অসাধারণ ব্যক্তি ও লাহোর প্রস্তাবকারী।বাঙালী জাতির মহান নেতা।মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে শেরে বাংলা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। জাতি হিসেবে আমরা যে সবাই বাঙালি-এই ঐতিহাসিক সত্যের মূল ভিত্তি তিনিই রচনা করেছেন। এই মহান জাতীয় নেতার মৃত্যুবার্ষিকী আজ। জাতি আজ তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে । অবিভক্ত বাংলার জাতীয় নেতা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্যাতিত ও শোষিত জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকে ২৭ এপ্রিল ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি অবিভক্ত বাংলার সাহসি এ প্রান পুরুষ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরকালে পারি জমান চিরদিনের জন্য।আজীবন মানুষের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে বাংলার বাঘ।

 

শেরে বাংলা ফজলুল হক একটি অবিস্মরণীয় নাম, এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও ঋণশালীশী বোর্ড গঠনকারী। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের নেতা ও অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতিতে ‘শেরে বাংলা’, ‘হক সাহেব’ আবার কখনো ‘বাংলার বাঘ’ নামে পরিচিত এই নেতা। বাঙ্গালি মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে শেরে বাংলা। তিনি ছিলেন শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের অতি আপনজন। শেরে বাংলা ফজলুল হকই প্রথম বাঙালি হিসেবে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাজনৈতিক গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বহুগুণের অধিকারী ছিলেন, বাংলার মানুষের কাছে তিনি শের-ই বাংলা হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

 

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৯ অক্টোবর বরিশাল জেলার বানরীপাড়া থানার চাখার গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ওয়াজেদ আলী সাহেব ছিলেন বরিশালের খ্যাতনামা আইনজীবীদের অন্যতম। বিপুল ঐশ্বর্যশালী পিতার একমাত্র সন্তান হলেও ফজলুল হক বাল্যকাল থেকেই বহু সদগুণের অধিকারী ছিলেন। তেমনি শৃঙ্খলা ও আদর্শের প্রতি অনুরক্ত করেই গড়ে তোলা হয়েছিল তাঁকে। শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বাল্যকাল থেকেই তেজস্বিতা, তীক্ষ্ণ মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ঘরেই তাঁর আরবী, ফারসি ও উর্দু শিক্ষা শুরু হয়। তিনি একমাত্র বাংলার প্রধানমন্ত্রী যিনি একাধারে ২৩ টির উপরে ভাষা জানতেন। এমন মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

অসম্ভব মেধাবী হিসেবে বাল্যকাল থেকে তিনি আবির্ভাব হন।মাত্র ১৪ বছর বয়সে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণীর বৃত্তি এবং পরিতোষিকসহ ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এফ. এ এবং পরে রসায়ন বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা ও গণিতে অনার্সসহ বি. এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৫ সালে অঙ্কে এম. এ. পাস করেন। বরিশালের রামচন্দ্র কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনার পর ১৮৯৭ সালে তিনি বি. এল. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরই তিনি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী রূপে ১৯০০ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্টেটের চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তেজস্বী হক সাহেব সরকারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯১১ সালে চাকরি ছেড়ে আবার আইন ব্যবসায়ে নেমে পড়েন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিন ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। ১৯২০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মন্টেগু-চেমসফোর্ট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে লীগ কংগ্রেসের যুক্ত অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তাই বিখ্যাত ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়। ১৯১৮ সালে ফজলুল হক লিখিত ভারত মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে সভাপতি হিসেবে তাঁর দেওয়া ভাষণ ইতিহাসের এক স্বর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ১৯২৫ সালে তিনি বাংলার মন্ত্রী সভার সদস্য মনোনীত হন।১৯২৭ সালে তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে তিনি বিলেতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। সেখানে তাঁর ব্যক্তিত্ব পূর্ণ বক্তৃতা সবার মনে সাড়া জাগায়। ১৯৩৫-৩৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন এ পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালি মুসলমান।১৯৩৭ সালে শের-এ-বাংলা এ. কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাঁকে উপাধি দেয়। শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ। সে থেকে তিনি শের-ই-বাংলা নামেই পরিচিত।

১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। এ সময়ে তিনি ‘ঋণ সালিশী বোর্ড’ গঠন করেন। এর ফলে দরিদ্র চাষীরা সুদখোর মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৫২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের এডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর-অব-ল এবং ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁকে ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্বজীবনীতে বলেন -“আমি নেতা নই, আমি আপনাদের মতোই কর্মী। ঐ যে সামনে কবরে ঘুমিয়ে আছেন সোহরাওয়ার্দী ও শের এ বাংলা, তারাই আমার নেতা। আজ থেকে আমি এই রেসকোর্সের নাম বদলে দিচ্ছি, এটা আজ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর আইয়ুব নগর আজ থেকে পরিচিত হবে শের এ বাংলা নগর নামে।”

শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এদেশের সাধারণ মানুষের জন্যে যা করেছেন, অন্য কোন জনদরদী নেতার পক্ষে এ যাবৎ তা সম্ভব হয়নি। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্যে তিনিই সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা ছিল তাঁর আজীবনের। তাঁরই প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ, লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ, তাঁর স্বগ্রাম চাখারে ফজলুল হক কলেজ এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

কৃষকপ্রজা আন্দোলন, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ও ঋণ সালিশী বোর্ড প্রবর্তনের জন্যে তিনি বাংলার দারিদ্র্য-নিপীড়িত কৃষক সমাজের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।ব্যক্তিগত দানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হাতেম তাই। তাঁর গোপন দানে কত দুঃস্থ কন্যাদায় গ্রস্ত পিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, কত ছাত্র পরীক্ষার ফি দিয়ে নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিয়েছে, তাঁর দানে যে কত সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কত পীড়িতের দুঃখমোচন হয়েছে তার হিসেব নেই। তাঁর জীবনে আরও যে কত সৎগুণের সমাবেশ ঘটেছিল, ইতিহাসও তার সব খবর রাখেনি। বাংলার নয়নমণি শের-এ-বাংলা এ. কে ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল প্রায় ৮৯ বছর বয়সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

বাংলার বাঘ খ্যাত জনদরদী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ নেতার মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে সারা বাংলায় নেমে আসে শোকের ছায়া, শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে সমগ্র দেশবাসী। ঢাকার পুরানো হাইকোর্টের পাশে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়।ফজলুল হক আমাদের মাঝে বেঁচে নেই; কিন্তু বাঙালি সমাজ যত দিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তাদের হৃদয়ে ফজলুল হক চিরজীবী। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝিনে। ওসব দিয়ে আমি ফজলুল হককে বিচার করিনে। আমি তাঁকে বিচার করি গোঁটা দেশ ও জাতির স্বার্থ দিয়ে। একমাত্র ফজলুল হকই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে পারে। সে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্ব ও সাচ্চা মুসলমানিত্বের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।’

তিনি শুধু বাঙালী নয় সারা বিশ্বের জন্য একজন সত্যিকারের আদর্শিক,সাহসী, দার্শনিক, রাজনীতির মহাপুরুষ,মেধাবী, সুবক্তা নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যাক্তির মৃত্যুতে জাতির মহাপ্রলয় সৃষ্টি হয়।তার প্রতি অতল শ্রদ্ধা করবে বাঙালী জাতি। তিনি চির অম্লান,চিরঞ্জীব ও শ্রদ্ধার পাত্র।আপনার কর্মময় জীবন নিয়ে বাঙালী জাতি বেচে থাকবে। আপনি ইতিহাসের এক মহানায়ক আপনি বাঙালীর জনদরদী,আপনি বাঙালীর বিবর্তন এর রুপকার। আল্লাহ প্রিয় নেতাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।আমিন।

লেখক – তসলিম উদ্দীন রানা, সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটি,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট।