জি এম সাইফুল ইসলাম »
গতকাল (১৯ জুলাই) একদিনে দেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১ হাজার ৭৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায়। ডেঙ্গু জ্বর এমনিতেই সেরে যায়, তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর মারাত্মক হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম কারণ এডিস মশার কামড়। আলো-আাঁধারিতে (সকাল-সন্ধ্যা) এডিস মশা কামড়ায়। এই এডিস মশা কিন্তু অন্য কোথাও থেকে উড়ে এসে কামডিয়ে যায় না। আমাদের ঘর বাড়ি চারপাশে রয়েছে এডিস মশার বাসস্থান। বলা যায়, আমরা নিজেরাই এ মশা পালন করি, নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করি। আমাদের চারপাশের ফুলের টব, ভাঙা হাড়ি-পাতিল, কলস, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, কৌটা, নারিকেল বা ডাবের খোসা, ইত্যাদি যেখানে স্বচ্ছ পানি থাকে সেখানে এডিস মশা বংশ বৃদ্ধি করে অথবা রেফ্রিজারেটর এবং এসির জমে থাকা পানিতেও এডিস মশা বংশ বৃদ্ধি করে।
ডেঙ্গু হলে শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১০৪ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মাথাব্যথা, মাংসপেশি ও চোখের পেছনে ব্যথা, পেটে ব্যথা এবং হাড় বিশেষ করে মেরুদণ্ডে ব্যথা, অরুচি, বমি বমি ভাব দেখা দেয়। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ ও চোখে রক্ত জমাট রাঁধতে পারে। লালচে কালো রঙের পায়খানা, দাঁতের মাড়ি নাক মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। রক্তচাপ হ্রাস, নাড়ির গতি দ্রুত হওয়া, ছটপট করা, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, শ্বাষকষ্ট বা অজ্ঞান হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হতে পারে। শরীরে হামের মতো দানা দেখা দিতে পারে। মারাত্মক (হেমোরেজিক) ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে শরীরের অন্তঃস্থিত বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ হতে রক্তক্ষরণ এবং পেটে ও ফুসফুসে পানি জমতে পারে।
জ্বর বা ডেঙ্গু হলে আতংকিত হওয়া যাবে না। দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কানকথায় বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। দ্রুত জ্বর কমানো জরুরি। এজন্য মাথায় পানি দিতে হবে এবং ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন অবস্থাতেই এসপিরিন/ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল ও স্বাভাবিক খাবার খেতে দিতে হবে এবং দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জ্বর সেরে গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। জ্বরের শেষেই সাধারণত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। অবশ্যই জ¦র সারার পরও কয়েকদিন সাবধানে ও ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হবে।
সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। সরকার নামমাত্র মূল্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু জরের পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। সে মোতাবেক চলছে পরীক্ষা কার্যক্রম। ডাক্তার নার্সরা দিনরাত চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে ১৮ কোটি মানুষের দেশে শুধু কিছু সংখ্যক ডাক্তার নার্সদের উপর ভরসা করলে বা তাদের উপর দায় চাপিয়ে দিলে চলবে না। কেউ একাকি কিছু করতে পারে না। এ বিষয়ে প্রত্যেক কে কাজ করতে হবে।
আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করবো- এ ভরসায় না থেকে আক্রান্তের আগেই প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিরোধের উপায়ও জানতে হবে। ফুলের টব, ভাঙ্গা হাড়ি পাতিল, কলস, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, কৌটা, নারিকেল বা ডাবের খোসা, রেফ্রিজারেটর এবং এসির তলায় যাতে পানি জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেসব স্থানে মশা জন্মায় সেসব স্থানে পানি জমতে না দেয়া, বাড়ির ভেতর আশ-পাশ ও আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখতে হবে।
দিনে বা রাতে যেকোন সময় ঘুমাতে গেলে মশারির ব্যবস্থা করতে হবে। মশার কামড় এড়াতে গা ঢাকা হালকা রঙের পোশাক পরতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় জ্বরের রোগীকে অবশ্যই সবসময় মশারির মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির ছাদ বা উঠানে বৃষ্টির পানি জমে থাকলে তা দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। ওভারহেড পানির ট্যাংক ও আন্ডারগ্রাউন্ড পানির রিজার্ভারের মুখ সবসময় ঢেকে রাখতে হবে। তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে।
অব্যবহৃত পানির পাত্র উল্টে রাখতে হবে যাতে পানি না জমতে পারে। মশারি ভালভাবে খাটিয়ে ঘুমাতে হবে। প্রয়োজনে শরীরের অনাবৃত স্থানে মশা প্রতিরোধী ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সচেতনতার বার্তাগুলো বেশি বেশি ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু নিজে জানলে হবে না, পাড়া প্রতিবেশিকে জানাতে হবে। সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। কেননা প্রতিবেশির বাড়িতে ডেঙ্গু হলে আমিও নিরাপদ নই- এটা মাথায় রাখতে হবে।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। ১৯ জুলাই সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রকাশিত তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১১৮ জন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৬৪ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৪ জন রোগী। এবছর এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ জন। এর মধ্যে চলতি জুলাই মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মিলেছে ১ হাজার ২১৮ জন। এ পর্যন্ত মোট ২০ জন ডেঙ্গুতে মৃত্যু বরণ করেছে।
চট্টগ্রামের বছরভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ডেঙ্গু রোগী ছিল ১৭ জন, ২০২১ সালে ২৭১ জন, ২০২২ সালে ৫ হাজার ৪ শত ৪৫ জন এবং চলতি বছর জুলাই’র ১৭ পর্যন্ত ১ হাজার ৪ শত ৬৪ জন। বছরভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২০ সালে কেউ মারা যায় নি, ২০২১ সালে মারা গেছে ৫ জন, ২০২২ সালে ৪১ জন এবং চলতি বছরের ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৮ জন। এ বছর জানুয়ারি মাসে ৩ জন, জুন মাসে ৬ জন এবং ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১১ জন মিলে মোট ২০ জন মৃত্যু বরণ করেছে।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু মশা নিধনের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিতে চলছে ব্যাপক কার্যক্রম। ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নালা নর্দমা পরিষ্কার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মশা নিধনে ওষুধ ছিটানো হয়েছে। প্রতিদিন চলছে কোথাও না কোথাও ওষুধ ছিটানোর কাজ। ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে মশার লার্ভা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্টের অভিযান চালানো হচ্ছে। সিভিল সার্জন অফিস হতেও এ বিষয়ে যথেষ্ট কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে শষ্যা সংখ্য্যা বাড়ানো হয়েছে। শুধু মহনগরীতে নয় জেলার ১৫টি উপজেলার সবকটিতে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, গণমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম। তবে জনসাধারণের কার্যকর অংশ গ্রহণ ছাড়া কোন ক্যাম্পেইন স্বার্থকতা লাভ করেনা। তাই জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের স্বার্থে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। তবেই গড়া যাবে ডেঙ্গু মুক্ত বাাংলাদেশ।
লেখক : তথ্য অফিসার, পিআইডি, চট্টগ্রাম।