স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট ও দায়িত্বশীল নাগরিক গঠনের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ বির্নিমানে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো সম্প্রীতির উৎসব। রোববার শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উৎসব উদযাপিত হয়। বাংলাদেশে নরওয়ে দূতাবাস এবং আইসিটি বিভাগের সহায়তায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)’র “পার্টনারশিপ ফর এ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (পিটিআইবি)” প্রকল্পের ‘ডাইভার্সিটি ফর পিস’ এটুআই- এসপায়ার টু ইনোভেট, ইউনেস্কো, একশনএইড বাংলাদেশ, ইন্সটিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), দি এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) যৌথ আয়োজনে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, কুপমুন্ডকতায় ভরা পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজের বীজ রোপন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এক বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে দেয়নি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। সহনশীলতা ও মুক্ত চিন্তার জন্য এ উপমহাদেশ বহু আগে থেকেই বিখ্যাত। আমাদের যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বহু শতকের ঐতিহ্য তা ধংস করা হয়েছে উপনিবেশিকতার মাধ্যমে। তারা আমাদের মূল্যবোধের উপর অন্য মূল্যবোধ চাপাতে চেয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও ছিল সম্প্রীতি রক্ষা ও বৈচিত্র্য রক্ষার এক সংগ্রাম। আমাদের সরকার সবসময় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি করেছেন। আমরা পার্বত্য অঞ্চলের ভাইদের সাথে বহু যুগ ধরে সহাবস্থান করছি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা একসাথে যুদ্ধ করেছি। হ্যাঁ, চুক্তি হয়ত এখনো শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এজন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ও আছে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আমাকে পছন্দ করে না। কারণ আমি বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছি। অনেক ক্লিপ বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার চেষ্টা করে। তারা সংখ্যায় কম। দেশে সাধারণ মূল্যবোধের মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি। তবে প্রতিক্রিয়াশীলরা সংগঠিত। কর্ম জগতে নারীদের প্রবেশ ঠেকাতে অতিরক্ষণশীল মতবাদ তারা প্রচার করছে। এদের প্রচারণায় আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রভাবিত হয়ে যায়। সম্প্রীতি দুয়েকজন ক্রিকেটারও এমন প্রচার করেছে, নারীদের কাজে যোগদান বিষয়্।ে আমাদের দুর্ভাগ্য ৭৫ এর পরে সেই শক্তি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। উদার পশ্চিমের (লিবারেল ওয়েস্টের) অনেক দূতাবাসের কর্তারাও অনেক সময় এ ধারণার প্রচারকারীদের সাথে বৈঠক করে। যেহেতু গণতন্ত্র বিষযে তাদের একটা অবস্থান আছে। তা তারা করতে পারে। তবে আমাদের সহনশীল সমাজকে যারা অস্থির করতে চায়, তাদের নিয়ন্ত্রণে আমরা নিজস্ব উপায় সচেষ্ট আছি। থার্ড জেন্ডারের বিষয়টি যখন পাঠ্যপুস্তকে আসলো তাদের প্রতিক্রিয়া আপনারা দেখেছেন। এ ধরণের পরিস্থিতিতে আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করতে হয়।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আরো বলেন, সহনশীলতা ও ভিন্নতাকে গ্রহণের মানসিকতা অবশ্যই আমাদের তরুণদের াকতে হবে৷ কারণ আন্তর্জাতিক মানদন্ড এটাই। আমরা বলি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এ স্লোগান আমরা ব্যবহার করি। সেখানেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আক্রমণ করে। ট্রল করে। পার্বত্যবাসীর প্রতি দীর্ঘদিন যে অবিচার হয়েছিল, সে অন্যায়কারী গোষ্ঠী এখনো বেশ সক্রিয়। সামরিক শাসকরা সমতল েেক বাঙালিদের জোর করে ধরে নিয়ে সেখানকার জনমিতি বদলে দিতে চেয়েছিল। তারা শান্তি চুক্তির দিনও এর বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিয়েছিল। এরকম জটিল মাত্রা ও সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিততে আমাদের কাজ করতে হয়।
তিনি বলেন, আমাদের গত ১৪-১৫ বছরের অর্জনকেও বিবেচনা করতে হবে এই প্রেক্ষাপটে যে, সমাজে অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করেই আমাদের এগুতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা অপপ্রচার চলছে। সচেতন থাকতে হবে। বৈচিত্র্যকে গ্রহণে সামাজিক মানসিকতা বদলে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা দেখুন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা এখন সামাজিক স্বীকৃতি পায়। একসময় তাদের অন্তরালে রাখা হত।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতায় যেন কোনো হুমকি না আসে সে বিষয়ে আমরা সচেতন। বাংলা হবে আফগান এ স্লোগান যারা দিয়েছিল তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। সেটা না করলে দেশ আফগানিস্তান-পাকিস্তানের পথে এগিয়ে যাবে। যে সব দল ও সামাজিক শক্তি সহনশীলতা ও সম্প্রীতির সাথে আছেন তাদের নিয়েই আমরা দেশ পরিচালনা করব। পশ্চিমা কূটনৈতিকদের বলি, দেশে বৈশ্বিক মানদন্ডে যে অগ্রগতি হয়েছে তা অবশ্যই আমরা ধরে রাখব। গণতন্ত্র রক্ষার নামে সরকার ও দলকে যখন আক্রমণ করা হয়, তা দু:খজনক। ইউরোপ আজকের অবস্থানে একদিনে আসেনি। ৫০০ বছর অন্ধকার যুগ কাটিয়ে, উপনিবেশ করে, সারা বিশ্ব েেক সম্পদ আহরণ করে তারা এখানে এসেছে। গণতন্ত্র আমাদের এ ভূখন্ডের মানুষের মজ্জায়। প্রতিষ্ঠান দুর্বল হচ্ছে বলে, যে অভিযোগ করা হয় তা ঠিক নয়। আমাদের বাস্তবতা কি? আমাদের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। রাষ্ট্রের বিরোধীতকারীদের এখানে বছরের পর বছর পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বই স্বীকার করে না তাদের নিয়ে দেশ চালানো অনেক কঠিন। বিভিন্ন অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রবণতা যা দেখছি, তা যেন কমে। আমাদের সংগ্রাম আমাদের মতই হবে। বাইরে েেক যত কম হস্তক্ষেপ হবে ততই ভালো হবে।
বিশেষ অতিথি নরওয়ের রাষ্ট্রদত স্পেন রিকটার এসভেনডসেন বলেন, অসাধারণ এক ধারণা সম্প্রীতির উৎসব। সম্প্রীতি ও সহনশীলতা এত সহজ নয়। ভিন্নতাকে মেনে নেয়া হলো সহনশীলতা, এটা কঠিন। অনুশীলনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য সম্প্রীতি প্রয়োজন। শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য সম্প্রীতি প্রয়োজন। আমরা দ্বিধায় ভুগি টলারেন্স নিয়ে। সবার ভিন্ন মতে আমরা এক মত হব তা নয়। কিন্তু অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ দিতে হবে। ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়া যোগাযোগের অবারিত সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু মিথ্যা তথ্য ছড়ানো সহ নানা কারণে তা সংকটেরও জন্ম দেয়। অন্তর্ভুক্তিম্লক সমাজ থাকলে নানা বৈষম্য ও প্রতিহিংসা ছড়ানো বন্ধ করা সম্ভব। তারুণ্যের শক্তিই সবসময় এগিয়ে যেতে পারে এ কাজে।
বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য দীপঙ্কর তালুকদার লিখিত বক্তব্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতির জনকের আশা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সকল ধর্ম বর্ণ জাতির মানুষের জন্য। সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবাইকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব।
বিশেষ অতিথি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সম্প্রীতির উৎসব বেশি করে হওয়া দরকার। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার চট্টগ্রাম। এখানে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করছে। জাতির পিতা অসম্প্রাদিয়ক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের নীতি অনুসরণ করছেন। এই প্রযুক্তির যুগে মিস ইনফরমেশন অহরহ দেখতে পাই। যে কোনো তথ্য সোশাল মিডিয়াতে আসলেই সেটাকে সত্য বলে ধরে নেয় মানুষ। যা নানা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদ দেশ গড়তেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন।
বিশেষ অতিথি চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক ও বিভ্রান্তমূলক বক্তব্য ছড়ানো হয়। যারা এসব করে, তারা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু তারা মনে করে তাদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুরা আছে। কিন্তু বিষয়টা তেমন নয়। আমরা চাকমা সার্কেল চেষ্টা করছি সকল সম্প্রদায়ের সঙ্গে সকল ধর্মের মানুষের যাতে সহবস্থান হয়। পাহাড়ে বাঙালিসহ, সকলেরই সম্প্রীতির বন্ধনে রাখার চর্চা অব্যাহত আছে। কিন্তু আগে থেকেই যদি বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়ানো হয় তাহলে সহাবস্থান নিশ্চিত হয় না। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশেষ অতিথি ইউনেস্কো’র অফিসার ইন-চার্জ সুসান ভাইজ বলেন, ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে শেখানো হয়, আমাদের মত নয় তাই খুব বিপদজনক। তাই স্বত:স্ফূর্তভাবে আমাদের মধ্যে েেক সম্প্রীতি আসবে না। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে ও সচেতন থাকতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা কাজ করছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাে কাজ করছি। নবীনদের বৈচিত্র সম্পর্কে সচেতন করতে। আইসিটি মন্ত্রণালয়ও নিরাপদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিরাপদ করতে এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক গড়তে আমাদের সাথে কাজ করছে।
আইসিটি ডিভিশনের পিটিআইবি প্রকল্পের পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, আমাদের মূল ফোকাস সাইবার বুলিং থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখা। সব শাখার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতেই এমন আয়োজন। ত্য প্রযুক্তির যুগে সবার জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের মহাপরিকল্পনায় সম্প্রীতির উৎসব এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা।
এর আগে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে উৎসবের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের উপ-আবাসিক প্রতিনিধি সোনালি দয়ারাতেœ। বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গর্ভনিং বডির সদস্য নিরুপা দেওয়ান, ইন্সটিটিউট ফর ইনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) এর নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, ইউনাইডটেড থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাকশন (উৎস)’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল যাত্রা।
উৎসবের উদ্বোধনী পর্বের সমাপনী বক্তব্য রাখেন পিটিআইবি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক রবার্ট স্টোলম্যান। উদ্বোধনী পর্বে চাকমাদের উবগীত, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সঙ্গীত, মেয়েদের মার্শাল আর্ট, পাপেট শো এবং ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির সদস্যদের গীতিনাট্য পরিবেশ করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় পর্বে সহনশীলতার প্রতি দরুণ ভাবনা শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সহনশীলতা কিভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে সে সম্পর্কে তরুণদের মতামত নেয়া হয়। ইউএনডিপির সিনিয়র গর্ভনেন্স স্পেশালিস্ট শীল তাসনিম হকের সঞ্চালনায় এই পর্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক এর রিসার্চ ম্যানেজার আবু সাইদ মো. জুয়েল মিয়া।
সমাপনী পর্বে নাটক- ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ মঞ্চস্থ হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করে ‘টঙের গান’ ও সাওতাল ব্যান্ড ‘আংরা’। দিনব্যাপী আয়োজনে আরো ছিল চিত্র প্রদর্শনী, পাপেট শো ও এম্পেথি গেম।