এম হাশেম তালুকদার »
শিক্ষকতা কারো জন্য কেবল পেশা, আবার কারো জন্য পেশা ও নেশা। কেউবা আবার এটাকে কেবল পেশা বা নেশা হিসেবে নয়, বরং মিশন হিসেবে গ্রহণ করে। যাঁরা মিশন হিসেবে গ্রহণ করে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত উপকৃত হয় শিক্ষার্থী, সহকর্মী, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বাবাসী। সাহিত্যেও আমরা এমনটি দেখতে পাই। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তেমনই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও সকলেই আদর্শ শিক্ষক হতে পারে না। সকলেই শিক্ষার্থীর ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না, তাদের কৌতূহল উদ্রেক করতে পারে না, আর যারা কৌতূহলী হয় তাদের কৌতূহলকেও শুভ চোখে দেখে না। আর যাঁরা এসব অতিক্রম করতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে মহান, কালের আয়নায় তারা অনসরণীয় তো বটেই। শিক্ষাথীদের হৃদয় জয় করা এমনই কয়েকজন শিক্ষক। যারা আজ চট্টগ্রাম মহানগরের পাচঁলাইশ থানাধীন পাচঁ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আজ নিজের কর্মস্থল ত্যাগ করে অবসরে গেলেন।
সমাজে প্রতিটা সেক্টরেই অলরাউন্ডার জন্ম গ্রহণ করে। সে অলরাউন্ডাদের প্রথম কারীগর হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা বা প্রাথমিকের শিক্ষক শিক্ষিকারা। তাদের অনুপ্রেরনা ও তাদের ভালোবাসায়, তাই আজ বিদায় বেলায় কোমলমতি ছাত্র/ছাত্রীরা আবেগে আপ্লুত। যারা আজ বিদায় নিয়ে অবসরে যাছেন তাদের আজিবন স্বরণ করবেন,তাদের আদর্শ আর তাদের কথা পালনে ব্রত হবেন শিক্ষার্থীরা। যারা অবসরে যাচেছন তাতের শুধু অনুসরণ নয়, নিঃসন্দেহে অনেক বিষয়েই অনুকরণের যোগ্য তারা। যেমন অবসর যাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে একেক জন একেক গুণের অধিকারী। কেউ পাঠদানে শ্রেণী কক্ষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহজ ভাষায়, কখনো বা গল্পে গল্পে, কখনোবা নানা উপকরণযোগে বুঝানোর চেষ্টা করতেন। এসব ম্বৃতি কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কোন দিন ভুলতে পারবেনা।
কথায় বলে, ‘বাপ বানায় ভূত, আর শিক্ষক বানায় পুত!’ একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর জন্য সর্বদাই আশীর্বাদ স্বরূপ। বাগানে মালির কাজ কতই না নিখুঁত! দিনের পর দিন চারাগাছগুলোর কী যত্নই না তিনি করেন। আগাছা সাফ করেন। প্রয়োজনে চারাগাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দেন। সকাল-বিকাল আবার সেসব গাছে পানিও দেন। কী নিষ্ঠা, কী মমত্ববোধ তার এসব কাজে! তারপর একদিন ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে বাগান। চতুর্দিক আমোদিত হয় সুবাসে সুবাসে। শিক্ষকের কাজ এ মালির কাজের সঙ্গে তুলনীয়। কেননা তাঁর শ্রমসাধনায় এক-একটি শিশু কালক্রমে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়। তাদের সুকৃতি সমাজে আনয়ন করে সুখ সমৃদ্ধি।
তারা শিক্ষক হিসেবে শেষ কর্মদিবস পালন করে যখন আজ ২০২৪ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি বিদায় দিনের সামনে এসেছেন। তাদের অতিথ সামনে বার বার হানা দিবেই দিবে।
এমনি কয়েকজন বিদায়ী প্রধান শিক্ষকের বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন থানা শিক্ষা অফিসার মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন দিলরূবা জাহান থানা রির্সোস সেন্টার ইন্সট্রাক্টর, আবু তোরাব মোহাম্মদ হোসাইন,সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার,আবদুর রাজ্জাক সহকারী ইন্সট্রাক্টর আরো উপস্থিত ছিলেন দক্ষিন পাহাড়তলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাজী নাসরিন আকতার পুরো অনুষ্টান সঞ্চালনায় ছিলেন অসিম দেবনাথ ও শামীম আরা।
বিদায়ী অনুষ্টানে বক্তরা বলেন,শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে নিশ্চিতভাবেই শিক্ষক হয় শিক্ষার মেরুদন্ড। এরা এমন শিক্ষক হবেন আদর্শ শিক্ষক, যিনি তৈরি করবেন আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে এ ভাবনা নেই সে যেমন শিক্ষক নয়, তেমনই শিক্ষিতও নয়। শিক্ষকের স্বার্থকতা শুধু শিক্ষাদান করার মধ্যেই নয়, বরং শিশুকে তা অর্জন করতে সক্ষম করানোর মধ্যে। আর এ অসাধ্য সাধনের কাজটিতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন আজকের এ পাচঁগুণি শিক্ষক।
একজন শিক্ষকও মানুষ। তিনিও অন্যসবার মতোই সামাজিক জীব। তিনিও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারাও ভুলের ঊর্ধ্বে নন। হয়ত রাজনীতির যাতাকলে পড়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। কখনো ক্ষমতার তাঁবেদারি করেননি। এটা ক্ষমতার কালো চশমায় বিচার করলে হয়ত আপাতদৃষ্টিতে অন্যায় মনে হবে, কিন্তু মোটেই অপরাধ নয়। এ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেলে তেলে তৈলাক্ত! তারাও ক্ষমতার পুজো করে, তেল দিয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু তা করেননি অর্থাৎ তারা ভেঙেছেন কিন্তু মচকাননি। এখানেই একজন আদর্শ, মহৎ, গুণী শিক্ষকের স্বার্থকতা। তবু কথা থাকে। মানুষ ভালো গুণগুলোকেই মনে রাখে।
একজন শিক্ষকের রয়েছে শৈল্পিক মন। অনেকটা চিত্রশিল্পীর কাজের সঙ্গে তুলনীয়। একজন চিত্রশিল্পীর কাজ দেখুন। কী একাগ্রতা! কী নিষ্ঠা! তুলি ও রঙের খেলায় শিল্পীর নিপুণ হাতে এক-একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষকের কাজে এমনই একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার প্রয়োজন। শিল্পীর কাজ যদি বিশেষ রূপায়বের আদলে বিশেষ মনোভঙ্গি বা বস্তুও নির্মাণকর্ম হয়, তবে শিক্ষকও একজন শিল্পী। চিত্রশিল্পী ছবি আঁকেন আর শিক্ষক হচেছন শিশুর মন সুগঠিত করার শিল্পী। শিশুর মন বিমূর্ত জিনিস। এটি গঠন করা কতই না কঠিন কাজ! আর একাজেই যারা তাঁর সমস্ত জীবন-যৌবনকে ব্যয়ে করেছে,ঠিক তখনই তারা সফল যখন তাদের ছাত্র/ছাত্রীরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সফলতার শেষ প্রান্তে পৌছে গেছে।