পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরপর কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে অস্থির করে তুলেছে পাহাড়। জেলার দুটি উপজেলায় ব্যাংকের তিনটি শাখা লুট এবং একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অপহরণ করা হয়েছে ব্যাংক ম্যানেজারকে। লুট করা হয়েছে অস্ত্রও। আঞ্চলিক সশস্ত্র দল কুকি চিন ন্যাশনাল ফন্ট (কেএনএফ) এই ঘটনার জন্য দায়ী বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সারাদেশে যখন ঈদের আমেজ বিরাজ করছে তখন পাহাড়ের এই অস্থিরতা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলছে। এজন্য সরকার অশান্ত পাহাড়ে দ্রুত শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটায় সরকার তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইতোমধ্যে আইজিপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। শনিবার (৬ এপ্রিল) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বান্দরবান যাচ্ছেন। সঙ্গে থাকছেন বিজিবি মহাপরিচালকও। সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের দমনের কড়া নির্দেশনা দেবেন মন্ত্রী।

শুক্রবার (৫ এপ্রিল) র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীদের নির্মূলের পাশাপাশি রুমার সোনালী ব্যাংক থেকে লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। আজ রাতেই সেই অভিযান শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে উদ্ধারপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, মূলত পার্বত্য এলাকার সম্প্রতি বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তারা তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য এই ধরনের হামলা চালাচ্ছে।

ব্যাংক ম্যানেজার ও অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রুমা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলা উদ্ধার করা না গেলেও র‍্যাব, সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ সকলের প্রচেষ্টায় কোনো রকমের ঝুঁকি না নিয়ে কয়েকটি কৌশলের একটি ব্যাবহার করে অপহরণের শিকার নেজাম উদ্দীনকে সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

ব্যাংক ম্যানেজারকে কোন প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা হয়েছে সে ব্যাপারে র‌্যাব স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিপণ হিসেবে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় সন্ত্রাসীদের হাতে৷ এর ঘণ্টাখানেক পর তাকে বাজারের পাশে পাওয়া যায়৷ মুক্তিপণ নিয়ে দেন দরবার করেছেন পরিবারের সদস্যরা৷ অক্ষতভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে আশ্বাস দেওয়ার পরই টাকা দেওয়া হয়৷

এদিকে কেএনএফ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এমন একটি সময়ে চালিয়েছে যখন এই মাসেরই ২২ তারিখে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার কথা ছিল। ২০২২ সালে কুকি-চিনের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় তখন দাবি করেছিল যে, তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। তাদের ভাষায়, ‘সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য’ চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।

কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বম এর নাম গণমাধ্যমে এসেছিলো। তিনি ২০১২ সালে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস বা কেএনডিও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যা পরে কেএনএফ এ রূপান্তরিত হয়।

কেএনএফকে নির্মূল করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী জোরালো অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনীও এই অভিযানে সম্পৃক্ত হয়। গত বছর কেএনএফ-এর সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত চলে। বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হন। এমন প্রেক্ষাপটে কেএনএফের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত নিরসনের পথ বেছে নেয় সরকার।

গত বছরের মে মাসে কেএনএফ সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানায়। জুলাই মাসে কেএনএফ-এর সাথে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দুই দফা ভার্চুয়িাল আলোচনার পর ৫ নভেম্বর প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠক হয়। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল রুমার মুনলাই পাড়াতে। এরপর ৫ মার্চ বান্দরবানের রুমা উপজেলার বেথেল পাড়ায় সরকার ও কেএনএফ-এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি বৈঠক হয়েছে। আগামী ২২ এপ্রিল তৃতীয় দফায় সশরীরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি বাতিল করে দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির অন্যতম সদস্য ও বান্দরবানের সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু জানিয়েছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটির কাজ হচ্ছে কেএনএফ-এর সাথে সরকারের সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেওয়া। এই কমিটির কোনো দাবি পূরণ করা কিংবা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারে না। বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে এই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়।

শান্তি আলোচনা ভেস্তে দেবার জন্য কোন মহলের ইন্ধন রয়েছে কি না সেটিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন মনিরুল ইসলাম।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সম্প্রতি ব্যাংক ডাকাতি এবং ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় কেএনএফের সাথে সংলাপ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আগামীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে সংলাপ চালিয়ে সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।