ইরানের হামলার জবাব দেবে ইসরায়েল

ঘোর সংকটে মধ্যপ্রাচ্য

কে প্রথম গুলি ছুড়েছে- ইরান না ইসরায়েল, এ অনেক পুরনো, অমীমাংসিত তর্ক। কার্যকারণের দূর-অতীত না টানলেও একদম তাজা প্রেক্ষাপট এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ইরান শনিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলের ওপর আকাশপথে ‘কঠোর’ প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে। এর দিন বারো আগে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

এরই বদলা নিতে, যেমনটা দাবি করেছে তেহরান, ইসরায়েলের মাটিতে প্রথম প্রত্যক্ষ হামলা করা হয়েছে। এই হামলার উদ্দেশ্য, যথার্থতা ও অর্জন নিয়ে দুই শিবিরে প্রতিবিপরীত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। তেল-আভিভ আবার পাল্টা-হামলা করতে পারে, যার তোড়জোড় শুরু হয়েছে; এবং তেহরান বলে দিয়েছে- হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না তারাও, দিয়েছে আরও বহুগুণ বিধ্বংসী বদলার হুমকি। কথায় কথা বাড়ে; সামরিক বাড়াবাড়ি আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে। গাজা যুদ্ধের মধ্যেই এ ধরনের সামরিক সংঘাতের আবহে ঘোর সংকটে পড়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্য। বলা বাহুল্য, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এর প্রভাব থেকে বিশ^ও মুক্ত থাকবে না।

ইরানের হামলা ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা শনিবার দিবাগত রাত। ইসরায়েলের আকাশে বেজে ওঠে সতর্কতার সাইরেন। নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানায় ইসরায়েল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে বিস্ফোরণ হতে থাকে। আকাশ প্রতিরক্ষা এরই মধ্যে সক্রিয় করা হয়। এই হামলা করেছে ইরান; ইসরায়েলি অঞ্চলে এই প্রথম তাদের বিমান হামলা। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে- অন্তত ১৭০টি ড্রোন, ৩০টি ক্রুজ মিসাইল ও ১২০টি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান।

স্থানীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, আল আকসা মসজিদের ওপর দিয়ে ইসরায়েলের দখল করা অংশে বৃষ্টির মতো ড্রোন পড়ছে। তেল-আভিভ অবশ্য এসব ড্রোনের বেশিরভাগই আকাশে বিস্ফারিত করেছে। বিবিসি জানিয়েছে, ইরানের পাশাপাশি এসব হামলা ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়া থেকে করা হয়েছে। লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারাও এ সময় দুই দফা রকেট হামলা করেছে ইসরায়েলে। আল জাজিরা জানিয়েছে, হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষায় সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জর্ডান। এ কথার মানে হলো- এই হামলায় অন্তত নয়টি দেশ জড়িয়ে পড়েছে।

হামলায় ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা কেন্দ্র ও একটি বিমানঘাঁটি ধ্বংসের দাবি করেছে ইরান। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এ দাবি করেছেন। তবে ইসরায়েল বলছে, ৯৯ শতাংশ হামলাই তারা প্রতিহত করেছে, আর মাত্র একজন আহত হয়েছে।

প্রতিশোধ হামলার প্রেক্ষাপট
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রবিবার ইরান এই হামলা করার কারণ জানিয়েছে। দেশটির দূত আমির সায়িদ ইরাভানি বলেন, তার দেশের স্বাভাবিকভাবেই আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আর হামলার মধ্য দিয়ে ইরান সেই অধিকারই রক্ষা করেছে।

দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও তাদের মিত্রদের লক্ষ্যবস্তু করে আসছে ইসরায়েল। তবে ১ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলা চালানো হয়। হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর শীর্ষ এক কমান্ডার ও তার ডেপুটিসহ অন্তত ১১ জন নিহত হন।

ওই সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছিলেন, ‘প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে ইহুদিবাদী ইসরায়েল নিজেকে রক্ষার জন্য তার অ্যাজেন্ডায় অন্ধ হত্যাকা- ফিরিয়ে এনেছে। এটা অবশ্যই জানতে হবে যে, তাদের এই লক্ষ্য কখনই অর্জন হবে না এবং এই কাপুরুষোচিত অপরাধের জবাব দেওয়া হবে।’

ওই হামলার উল্লেখ করে রবিবার ইরানি দূত ইরাভানি বলেন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। পাল্টা জবাব দেওয়া ছাড়া তেহরানের হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি আরও বলেন, ‘ইরান উত্তেজনা বা যুদ্ধ চায় না। তবে যে কোনো হুমকি বা হামলার জবাব দেবে ইরান।’

ইসরায়েল কি আবার হামলা চালাবে
প্রধানরমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে একজন যুদ্ধবাদী নেতা, গাজায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। ফলে তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী যে আবার ইরানে সামরিক হামলা চালাবে না, তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। উল্টো তার প্রতিরক্ষা বাহিনী ঘোষণা করেছে- তারা ইরানে অবশ্যই হামলা করবে। তবে কখন ও কী মাত্রায় হামলা করা হবে, এ বিষয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিত কিছু বলেনি তারা।

এদিকে নেতানিয়াহু ও তার যুদ্ধপন্থি মন্ত্রিসভা এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও সেনাবাহিনী দফায় দফায় বৈঠক করছেন। তারা ইরানকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার ব্যাপারে ‘বদ্ধপরিকর’। পশ্চিমা নেতাদের সতর্কতা সত্ত্বেও যুদ্ধ মন্ত্রিসভা ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক উভয় পদক্ষেপই অনুমোদন করেছে- এমন খবর পাওয়া গেছে।

কী বলছে ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এবং ইরসায়েলের অন্য মিত্র দেশগুলো ইরানকে বিশে^র জন্য ‘সত্যিকারের নিরাপত্তা-হুমকি’ বলে অভিহিত করে বলেছে, তেহরানকে ঠেকাতে তাদের যা-যা করণীয়, সবই তারা করবে। কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে ইরানি রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে। আর রবিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিপক্ষে ও ইসরায়েলের পক্ষে একপেশে ভাষ্য তুলে ধরেছে এসব দেশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এরই মধ্যে প্রকাশ্যে জানিয়েছে- তারা বাড়তি কোনো সামরিক সংঘাত চায় না।

হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছেন, ইরানে যেন ইসরায়েল হামলা না চালায়। তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ‘সতর্কতার সঙ্গে ভাবার’ পরামর্শ দিয়েছেন নেতানিয়াহুকে।

কোন দিকে মোড় নেবে সংঘাতের পরিণতি
ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার সম্ভাব্য পরিণতি কী হবে- এ নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ তুলে ধরছে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যেমন- বিবিসির নিরাপত্তা সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার বলেছেন, সংঘাতের পরিণতি কী হতে পারে তা নির্ভর করছে ইসরায়েল এখন কী করবে, এর ওপর। তেল-আভিভ মিত্রদের কথা মতো ‘কৌশলগত ধৈর্য প্রদর্শন’ করতে পারে।

আবার, ইরানের মতোই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা হামলা করতে পারে, তবে তা সতর্কভাবে শুধু সামরিক স্থাপনায়। এমনকি ইরান যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী পাল্টা হামলাও তারা চালাতে পারে। বিশেষ করে তৃতীয় বিকল্পটি বেছে নিলে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়তে পারে। এবং এর প্রভাব পড়বে প্রথমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও পৃথিবীজুড়ে।