পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস এ তিন সংকটে চট্টগ্রামে নগরজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। নগরীর ৫০ লাখ মানুষের জন্য পানির চাহিদা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। অথচ এর বিপরীতে বর্তমানে উৎপাদন ৩৫ কোটি লিটার। চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১১০০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াট।
চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৩২০ এমএমসিএফের বেশি হলেও গড়ে ২৬৭ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় বাসায় পানি থাকলে গ্যাস থাকে না। আর গ্যাস থাকলে বিদ্যুৎ থাকে না। এমন অবস্থা চলছে নগর জুড়ে। এ তিন সংকটের কারণে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রশাসনিক এলাকার আয়তন ৬০ বর্গকিলোমিটার। এরমধ্যে চট্টগ্রাম নগরীকে দেখভালের প্রধান দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা।
নগরীকে পরিচালনাকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলোর (ওয়াসা,পিডিবি, কেডিসিএল, বিটিসিএল) কাজের মধ্যে কোনো সম্বন্বয় নেই। সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। যার ফলে প্রায়ই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কাজের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। এর ফলে সুষ্ঠু কোনো কাজ হয় না। আর এর খেসারতও দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। দীর্ঘ ৫০ বছরেও চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ি করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, চাহিদার অনুপাতে চট্টগ্রাম ওয়াসার উৎপাদন এক তৃতীয়াংশ মাত্র। লোডশেডিং, পাম্প নষ্ট ও সিস্টেম লসের কারণে প্রায়শ: এ উৎপাদনও বহাল থাকে না। চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা এ মুহূর্তে ৫০ লাখ। পানির চাহিদা দৈনিক ওয়াসার হিসাবে ৫০ কোটি লিটার। অথচ এর বিপরীতে বর্তমানে উৎপাদন ৩৫ কোটি লিটার। প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানির সংকটে রয়েছে নগরবাসী। লোডশেডিং, পাম্প নষ্ট থাকা ইত্যাদি কারণে ওয়াসর উৎপাদন ব্যাহত হয়। এসব কারণে গড়ে এক থেকে দুই কোটি লিটার পানি কম উৎপাদন হয়।
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নগরবাসীর চাহিদামতো পানি তারা উৎপাদন করতে পারছে না। যার কারণে এলাকাভেদে ‘রেশনিং’ করে পানি সরবরাহ করছে তারা।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুল্লা নগরে পানি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘নগরে মানুষের চাপ বাড়ছে। তাই পানির চাহিদাও বেড়েছে। এ সংকট উত্তোরণে কাজ চলছে।
নগরীতে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও গৃহস্থালীর কাজকর্মে একপ্রকার স্থবিরতা বিরাজ করছে। গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামে কোন শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যাচ্ছেনা, আসছে না কোন বিনিয়োগ। পাশাপাশি সরবরাহ কম দিতে পারায় চট্টগ্রামের ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ১৩টি বন্ধ রয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, যে কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তার উপর চট্টগ্রামে সাধারণত ১১শ মেগাওয়াট চাহিদা থাকে। সেখান থেকে আমরা গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ পাচ্ছি। যার কারণে বিভিন্ন জায়গায় শেডিং হচ্ছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, ‘চট্টগ্রামে গ্যাস-নির্ভর ৪ শতাধিক কারখানা ঠিকমতো গ্যাস ও বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রচণ্ড বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য যথাসময়ে পাঠাতে পারছে না। এর প্রভাব পড়ছে দেশের রপ্তানি খাতে।’
কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) ইঞ্জিনিয়ার আমিনুর রহমান বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস না পাওয়ায় আমরা ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি না। চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৩২০ এমএমসিএফের বেশি হলেও চট্টগ্রামে গড়ে ২৬৭ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।’
সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম এর সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম ইমন বলেন, চট্টগ্রাম নগরে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিক সমস্যাগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অসহনীয় লোডশেডিং বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন ও চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, দেশের বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ ও পানির জন্য হাহাকার চলছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১১০০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াট।
তারা বলেন, আর এ কারণে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে লোডশেডিং বেড়েছে প্রচণ্ড আকারে। এর ফলে চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ বিভিন্ন শিল্প, কলকারখানা, দোকানপাট, শপিংমল ও বাসাবাড়িতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এ অবস্থা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
তাঁরা বলেন, প্রচণ্ড-তাপদাহে স্বাভাবিক জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সেখানে লোডশেডিং মানুষের দুর্ভোগের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম গ্যাস,বিদ্যুৎ,পানি গ্রাহক কল্যাণ পরিষদ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, যে কোনো মূল্যে আমাদের প্রিয় শহর চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হবে। এজন্য সাধ্যমত যা করা সম্ভব,তার সব করতে হবে।
ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী বলেছেন, সুপেয় পানির জন্য মানুষকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বেসরকারি পানি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে কিনে পান করতে হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি না পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তির মাত্রা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্যাব নেতারা বলেন, শুরু থেকেই ওয়াসা লবণাক্ততার বিষয়টি গোপন করে এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে চট্টগ্রামের ওয়াসার পানিতে লবণের বিষয়টি আরো দু-এক বছর আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম ওয়াসা সতর্ক রয়েছে। যার খেসারত এখন জনগণকে দিতে হচ্ছে। লবণাক্ততা ও পানির সংকটের কারণে নগরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভোগান্তিতে আছে বললেও প্রকৃত অর্থে এই সংকটে অর্ধেকের বেশি নগরবাসী কষ্ট পাচ্ছে।
ক্যাব নেতারা আরও বলেন, নগরবাসী বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার লবণাক্ত পানি নিয়ে ভোগান্তিতে আছেন। পানি পরিশোধন করলেও লবণ যাচ্ছে না। অনেক জায়গায় নালার দুর্গন্ধযুক্ত, ময়লা ও কালো পানি পাচ্ছেন নগরবাসী। কেউ দূরদূরান্তের পুকুর ও গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে আনছেন। কেউ পানি কিনে রান্না ও খাওয়ার কাজ সারছেন। গোসলসহ অন্যান্য কাজ করতে পারছেন না। ওয়াসার বেশিরভাগ লাইন পুরোনো হওয়ার কারণে এমনিতেই সংকটে থাকতে হয় গ্রাহকদের।