সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বার আউলিয়ার শহর “চট্টগ্রাম”

 

ইতিহাস খ্যাত বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চাইতে এই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মান মর্যাদা অনেকগুণ বেশি। ইসলাম ধর্মের পবিত্র মর্মবাণী বাংলার জমিনে চট্টগ্রাম হয়ে অন্যত্র পৌঁছে। চট্টগ্রামকে বলা হয় বার আউলিয়ার শহর।

 

অতি পবিত্র ও পুণ্যভূমি হিসেবে ধর্মীয় মর্যাদায় এর অবস্থান খুবই আলাদা। চট্টগ্রামের জেলা ও শহরের এলাকাতে অসংখ্য পীর আউলিয়া, সুফী সাধক, পণ্ডিত, জ্ঞানী ও গুণী মনীষীর সম্মিলন। অলি ও পীর বুজুর্গদের চট্টগ্রামকে অনেক সুফী সাধকগণ চট্টগ্রাম শরীফ নামেও বলতে শুনা যায়। মূলত চট্টগ্রামের প্রতিটি মাটিতে মহান সাধকদের ধর্মচর্চায় মানুষ মানুষের জন্য এবং স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির কল্যাণে তাঁরা নিবেদিত হয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী প্রচার করেছেন। সত্য সুন্দর আলোর পথে তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার ধর্মহীন মানুষ পবিত্র ইসলাম ধর্মকে জড়িয়ে আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। সাধক পণ্ডিত, জ্ঞানী মহান ইসলাম ধর্মের বাণী প্রচারকারী একজন সাধক হলেন হযরত শাহসুফী টাকশাহ মিয়া (রহ)। তিনি চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার পুণ্যভূমির অন্যতম আউলিয়া। জ্ঞান, গুণী ও কারামত সমুজ্জ্বল এই মনীষীর পবিত্র মাজার রয়েছে চট্টগ্রামের ৫০ নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ সড়ক, ইমামগঞ্জ, প্যারেড পূর্ব কর্নারে চকবাজার, চট্টগ্রামে। তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, ফোরকানিয়া, মাদ্রাসা, হেফজখানা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ সবকিছু তত্ত্বাবধান এবং পরিচালনার জন্য ২৮ অক্টোবর ১৯৫৫ সালে “হযরত টাকশাহ মিয়া দরগাহ ও মসজিদ কমিটি” নামে সরকারি আইনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। জনহিতকর কর্ম ও মানবতার সেবা, অসহায় এতিম সন্তানদের লালন পালনে হযরত টাক শাহ মিয়া (রহ) দরগাহ ও মসজিদ কমিটির অবদান অপরিসীম।

পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আউলিয়া কেরামগণের অবদান বেশি। অন্ধকার-জ্ঞানহীন, ধর্মহীন মানুষকে যাঁরা সত্য পথের সন্ধান প্রদান করেন তাঁরা আমাদের আলোর দিশারী। চট্টগ্রামে বদর আউলিয়া, শাহ চান্দ আউলিয়া, মোহছেন আউলিয়া, হযরত আমানত শাহ (রহ), মোল্লা মিসকিন শাহ, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ), হযরত গরীব উল্লাহ শাহ (রহ), হযরত টাকশাহ মিয়া (রহ), হযরত জঙ্গী শাহ আল কোরাইশী (রহ), হযরত আক্রমণ আলী শাহ (রহ), হযরত শাহজাহান শাহ (রহ), হযরত কাতাল শাহ (রহ), হযরত ভঙ্গী শাহ (রহ), হযরত শাহ শরফুদ্দীন শাহ (রহ), হযরত সত্যপীর (রহ), হযরত বঈদ-দীন শাহ (রহ), হযরত মামা-ভাগনে (রহ), হযরত শাহ ওমর (রহ) সহ বাংলার জমিনের ভাণ্ডারী নিশানার প্রবর্তক হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রহ) এর প্রভাব এখনও বিদ্যমান। মূলত উল্লেখিত সাধক পুরুষগণ ছাড়াও এই বাংলার জমিনে প্রথম দ্বীন ইসলামের সু-সংবাদ নিয়ে আগমন করেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্রিয় সাহাবী হযরত সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা)। চট্টগ্রামের জঙ্গলকৃন্ন পাহাড়ি ভূমি ও সাগর নদী এলাকার লোকজনের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে হাজার বছর আগেও আমাদের আউলিয়া কেরামগণ কাজ করেছেন। তাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আমাদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের আশেপাশেই এলাকাতে এই মহান অলির নাম গুণে মুগ্ধ এলাকাবাসী প্রতিনিয়ত তার অনুগ্রহ কামনা করেন এবং দোয়া প্রার্থনা করেন। একজন মহান অলির আদর্শবাহী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এতিম শিশুদের লালন পালনের অন্যতম প্রতিষ্ঠানরূপে পরিণত হয়েছে।

হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) ও দরগাহ কমপ্লেক্স শিরোনামে একটি গ্রন্থে শেখ মুহম্মদ ইব্রাহীম হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) নিয়ে লিখেছেন, “চট্টগ্রামের অসংখ্য আউলিয়া-কেরামদের মাঝে হযরত টাক শাহ মিয়া (রঃ অন্যতম। তাঁর আসন নাম তারেক শাহ (রঃ)। তবে তিনি জনসাধারণের কাছে হযরত টাকশাহ মিয়া নামে সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রামের প্রাচীন কালের অলি-দরবেশগণের প্রায়ই আরবদেশীয়। এখানে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁদের আগমন। তাই তাঁদের পূর্ব পরিচিত পাওয়া খুবই মুশকিল। তাঁরা অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশ সমূহ, ইরাক-ইরান, সমরখন্দ-বুখারা, আফগানিস্তান এমনকি ভারতের বিহার ও অন্যান্য রাজ্য থেকে এখানে আসেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করা। তাই তাঁরা নিজেদেরকে জাহির করার জন্য কিছুই করতেন না। এমনকি তাঁদের আসল পরিচিত নামটির প্রতিও তাঁদের তোয়াক্কা ছিল না। স্থানীয় লোকজন তাঁদের কার্যকলাপ দেখে যে নামে ডাকতো সেই নামেই তাঁরা পরিচিত লাভ করেন। পার্থিব যশঃখ্যাতি, নাম-পরিচিতির জন্যে তাঁরা লালায়িত ছিলেন না; একমাত্র আল্লাহর পরম সান্নিধ্য লাভ করাই তাঁদের ধ্যান-ধারণা ছিলো।

হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) এর এই নামের পিছনে একটা প্রবাদ আছে এই দরবেশ টাক বাজাতেন। টাক হলো বাঁশের এক মাথায় গিরা বাকী রেখে উপরের অংশে দোফলা করে হাত তিনেক লম্বা যে জিনিসটি শব্দ সৃষ্টি করার জন্য তৈরি হতো, চট্টগ্রামের ভাষায় তার নাম ছিল টাক।  এটার বৈশিষ্ট্য হলো বাঁশটিকে গোড়া থেকে ঝাঁকুনি দিলে উপরের অংশে টাক টাক শব্দ বের হতো। তাছাড়া গাছের একটা খণ্ডকে গোলাকার করে ঘণ্টার মতো করে, মধ্যে একটি ছিদ্র করে আরেকটি লম্বা ছোট টুকরা মধ্যখানে স্থাপন করে গাছে লটকিয়ে আওয়াজ করা হতো। বিশেষ করে সেকালে ফসলের ক্ষেতে, ফলজাত বৃক্ষের ফলমূলে যেসব পশু পাখি ক্ষতিসাধন করতো তাদেরকে তাড়ানোর জন্যে এসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। সাধারণতঃ বন্যশূকর, সজারু, কাঠবিড়ালী, বানর এবং অন্যান্য পাখি তাড়ানো হতো এভাবে শব্দ করে।

বর্তমানে হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) এর মাজার চকবাজার প্যারেডের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় আন্ডাখানার যে স্থানে অবস্থিত সেখানে ঘন জঙ্গলাভূমি ছিলো। মাজারের পশ্চিম দিকে প্যারেডের সমতলভূমি বাদ দিয়ে পুরো পাহাড়ি এলাকটি ঘন জঙ্গল ছিলো। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ের বিস্তৃতি শুরু হয়। পাহাড়গুলো বড়বড় গাছপালা ও বনজঙ্গলে ভর্তি ছিলো। এসব পাহাড়-জঙ্গল থেকে বনের হিংস্র প্রাণীসহ অন্যান্য জন্তুগুলো আন্ডাখানার দিকে আসতো অনেক সময় শিকারের খোঁজে নতুবা পাশে প্রবাহিত চাকতাই খালের স্বচ্ছ জলধারা থেকে সুপেয় পানি পান করতে। একাকী জনশূন্য এই স্থানে হিংস্র বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্যে হযরত তারেক শাহ (রঃ) টাক টাক শব্দ করে টাক বাজাতেন। এই টাক বাজানোকে কেন্দ্র করে হযরত তারেক শাহের জনপ্রচলিত নাম টাক শাহ নাম ধারণ করে।”

প্রখ্যাত সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম লিখেছেন, “টাকশা মিঞা” নামের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য আছে, লোকে শুধু তাঁকে শাহ বা দরবেশ বলিয়া সন্তুষ্ট হয নাই। উহার সহিত ‘মিঞা’ও যোগ করিয়া দিয়াছে। ইহাতে মনে হয়, তাঁহার চেহারা চরিত্রে এবং লোকের চোখে তাঁর সম্ভ্রমশীলতা ছিল।”

হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) খুবই পরহেজগার, জ্ঞানী-গুণী সুফী সাধক ছিলেন। তিনি নীরবে ধর্ম প্রচার করেন এবং মানুষকে হেদায়তের পথে আহবান জানান। আউলিয়া-কেরামদের জীবনে অসংখ্য কারামত সংঘটিত হয়। কিছু প্রকাশ পায় আর কিছু অগোচরে থেকে যায়। হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) এর জীবনেও অনেক কারামত সংঘটিত হয়েছে, যা মাঝে মধ্যে প্রকাশ লাভ করে। তিনি এই নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় বসে ইবাদত বন্দেগী, রিয়াজত, মোশাহেদা করতেন। সামান্য একটি পর্ণকুটিরে তাঁর ইবাদতগাহ ও আস্তানা ছিলো। জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে তিনি রান্নার কাজ সারতেন। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় হিংস্র বন্য প্রাণী থেকে রক্ষার জন্য টাকশাল জ্বালিয়ে রাখতেন। শীতকালে টাকশালের পাশে বসে শীত নিবারণ করতেন। বর্তমানে শহরের প্যারেড কর্নারের পূর্ব পাশে তাঁর মাজারে প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুল কলেজ মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী, পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী লোক ছাড়াও ভিন্ন ধর্মের লোকদের দোয়ার উদ্দেশ্যে সমাগত হতে দেখা যায়। পবিত্র ও পুণ্য মানসে তাদের আগমন। হযরত টাকশাহ মিয়া (রঃ) এর কারামত ও জীবনী মানুষের কাছে সম্মান ও মর্যাদায় পৌঁছে প্রতিনিয়ত মানুষের আগমন এই এলাকার মানুষকে বিমোহিত করে। আমাদেরও প্রার্থনা মানুষের কল্যাণে মানুষ কথাটি মনে রেখে জীবন কাটিয়ে দিবে। সর্বক্ষেত্রে স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির কল্যাণে মানুষ নিবেদিত হবে এই হোক আমাদের প্রার্থনা। হযরত টাক শাহ মিয়া (রহ) এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ।

  • লেখক: সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, সভাপতি, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা