দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় নতুন আরেক মাইলফলক

দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা স্থাপিত হলো নতুন আরেক মাইলফলক। আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হওয়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন আজ শনিবার। এ উপলক্ষে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) মঞ্চ বানিয়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। বর্ণিল ও জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে সকাল ১০টায় এই প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে উদ্বোধনের পর দুপুর ১২টায় বিমানবন্দর সংলগ্ন মাঠে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সুধী সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। একইস্থানে আগামী ১৪ অক্টোবর শনিবার জনসভাটি করবে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। তবে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজ শনিবার শুধু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

এদিকে, উদ্বোধনের অংশ হিসেবে তৃতীয় টার্মিনালে গত বৃহস্পতিবার মহড়া দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ওইদিন পরীক্ষামূলকভাবে তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে বিমানের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নেপালগামী একটি ফ্লাইট পরীক্ষামূলকভাবে তৃতীয় টার্মিনালের পার্কিং বে থেকে বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহার

করে ফ্লাইটে ওঠানো হয় যাত্রী। তবে যাত্রীদের চেক ইন, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রস্তুতি পুরনো টার্মিনাল ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়। উদ্বোধনের দিনও তৃতীয় টার্মিনাল থেকে বিমানের একটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। এরই মধ্যে টার্মিনালের বে, বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহার করে ফ্লাইট পরীক্ষা করা হয়েছে।

বেবিচক জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল তিন তলা বিশিষ্ট। টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার ও প্রস্থ ২০০ মিটার। এ ভবনটির নকশা করেছেন রোহানি বাহারিন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিপিজি করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেড, সিঙ্গাপুরের স্থপতি। যাত্রীধারণ সক্ষমতা হবে বছরে ১৬ মিলিয়ন। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে এক হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে। উড়োজাহাজ পার্কিং বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য এক হাজার ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে থাকবে ৬টি চ্যানেল। চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকছে ১২৮টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ইমেগ্রেশন কাউন্টার ১৫টি।

এছাড়া থাকছে বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি, ভিভিআইপি ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৩টি। বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে প্রথম পর্যায়ে ১২টি। পরবর্তী সময় সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরো ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে। বর্তমান টার্মিনাল ২টির সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনো সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তীতে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।

বেবিচক কর্মকর্তারা আরো জানান, এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ (যন্ত্রপাতি স্থাপন, জনবল নিয়োগ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) করা হবে উদ্বোধনের পর। পরে আগামী বছরের ডিসেম্বরের দিকে টার্মিনাল ব্যবহারের সুযোগ পাবেন যাত্রীরা।

এ প্রসঙ্গে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, উদ্বোধনের দিন একটি উড়োজাহাজ তৃতীয় টার্মিনালের পার্কিং অ্যাপ্রোনে রাখা হবে। এখন ইকুইপমেন্টগুলো বসানোর কাজ চলছে। তবে সফট ওপেনিংয়ের পর এয়ারলাইনগুলো নতুন পার্কিং অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। আগামী বছরের শেষের দিকে যাত্রীরা টার্মিনালটি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারবেন। সফট ওপেনিং এর পর এদিন বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইট তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে ঢাকা ত্যাগ করবে। সেই ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংও করবে রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স। উদ্বোধনের প্রস্তুতি হিসেবে বিমানবন্দরে চলছে মহড়া।

তিনি জানান, এ টার্মিনালের একাংশে ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। টার্মিনাল-৩ এর পার্কিং বে-তে থেকে প্রথমবারের মতো ফ্লাইটে যাত্রী তুলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট।

বিমান কর্তৃপক্ষ জানায়, গত সোমবার বিমানের ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু রুটের ফ্লাইটটি (বিজি-৩৭১) প্রথমবারের মতো তৃতীয় টার্মিনালের হাই-স্পিড ট্যাক্সিওয়ে দিয়ে পার্কিং বে-তে প্রবেশ করে। পার্কিং বে-তে অবস্থানের পর তৃতীয় টার্মিনালের বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে ফ্লাইটে ওঠেন কাঠমান্ডুর যাত্রীরা। ফ্লাইটটি বিমানের বোয়িং-৭৩৭ মডেলের ‘ময়ূরপঙ্খি’ নামের একটি এয়ারক্রাফট নিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার একইভাবে টার্মিনাল-৩ ব্যবহার করেছে বিমানের ঢাকা-কাঠমান্ডু রুটের আরেকটি ফ্লাইট।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. শফিউল আজিম জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এর সফট ওপেনিং এর জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সম্পূর্ণ প্রস্তুত। টার্মিনাল-৩ এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য নতুন ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া, দায়িত্ব পালনকারী জনবলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের নতুন ইউনিফর্ম প্রস্তুত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। এরপর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। আর বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এই টার্মিনালের নির্মাণকাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং। তৃতীয় টার্মিনাল ভবন নির্মিত হলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় কোটি কোটি যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন।

শাহজালাল বিমান বন্দরের উত্তর পাশে রয়েছে রপ্তানি ও আমদানি কার্গো ভিলেজ। বর্তমান কার্গো ভিলেজের উত্তর পাশে যথাক্রমে ৩৬ হাজার বর্গমিটার ও ২৭ হাজার বর্গমিটার আয়তনের সর্বাধুনিক সুবিধা সম্পন্ন দুটি পৃথক আমদানি ও রপ্তানি কার্গো ভিলেজ নির্মাণ করা হবে। তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথ ও উড়াল সেতু নির্মাণ করা হবে। যার মাধ্যমে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয় টার্মিনালে থাকছে অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। পাশাপাশি লাউঞ্জ, দোকান, রেস্টুরেন্টসহ আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক যাত্রীসেবার সুবিধা রাখা হবে।

এছাড়াও এই টার্মিনাল ভবনে ১৬টি আগমনি ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি)-এর মাধ্যমে জাপানের মিৎসুবিশি ও ফুজিতা, জাপান এবং কোরিয়ার স্যামসাং টার্মিনালের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করবে।