ফজলুর রহমান :: একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্দিবৃত্তিক আড্ডায় উপস্থিতদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমরা কী জানো, এ রুমে একটি বাঁদর আছে।” বাঁদর শব্দটা আড্ডাস্থলের সকলকে চমকে দেয়। কথা থেমে যায়। একজন আর একজনের দিকে অবাকে তাকিয়ে থাকেন। কারও কারও মনে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে আবার বাঁদর এলো কিভাবে? কবিগুরু এ আচমকা কি বললেন? আড্ডাস্থলে কিছুটা নিরবতা নেমে আসে। তবে সকলের এমন দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাড়ি-গোঁফের আড়ালে থাকা হাসি আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। জোরছে শব্দ করেই হেসে উঠলেন তিনি, এরপর বললেন, “এ রুমের বাঁ-দিকে একটা ‘দোর’ অর্থাৎ দরজা আছে!” আড্ডাস্থলে তখন হাসির ফোয়ারা বয়ে যায়।
আসলে এ ধরনের রসবোধ একঘেয়েমি তাড়িয়ে আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে দেয়।
কবিগুরুদের ঠাকুরবাড়ির বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডার কথা বেশ পড়া কিংবা জানা আছে অনেকের। সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকে আড্ডার রেওয়াজ চালু ছিল। জোড়াসাঁকোর দোতলায় রবীন্দ্রনাথের বসার ঘরে বেশ ক’জন শিক্ষক, লেখক নিয়মিত আড্ডা দিতেন। পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের কোণার্ক বাড়িতেও এমন আড্ডার আসর বসত। আড্ডায় শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গ প্রাধাণ্য পেতো। পাশাপাশি সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিও বেশ গুরুত্ব পেত।
এই ধরনের আড্ডার ফলাফলকে অনেক বড় হিসেবে দেখছেন লেখক বুদ্ধদেব বসু। আড্ডার ফজিলত তুলে ধরতে গিয়ে এই লেখক বলেন, “সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পাটির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আডডা। ও না-হ’লে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে ওরই হাতে আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যাবৃক্ষের উচ্চশাখা থেকে আপাতরমণীয় ফলগুলি একটু সহজেই পেড়েছিলুম—সেটা আডারই উপহার। আমার সাহিত্যরচনায় প্রধান নির্ভর রূপেও আড্ডাকে বরণ করি। ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হ’লো।”
এভাবে আড্ডা কোন কোন জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ চর্চিত বিষয় হিসেবে ধরা দেয়। দরদী শিল্পী মান্না দে হাহাকারে গেয়েছিলেন, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী বিকেলগুলো সেই। আজ আর নেই।’ গানটি আজো নাড়া দিয়ে যায়। কারণ আড্ডার একটি চিরন্তন আবেদন আছে। আড্ডা যেন এক অফুরন্ত প্রাণশক্তির উৎস। যে কোন বিষয়ের নানা দিক, অভূতপূর্ব সব ব্যাখ্যা, যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, উদাহরণ, রসযোগ-এসব মিলিয়ে এক অসাধারণ এক অনুভূতির নাম আড্ডা। এই আড্ডার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে মূল কেন্দ্রে ফোরাম বলে একটি জায়গা থাকত। এই ফোরামই ছিল গ্রীক ও রোমানদের মূল আড্ডার জায়গা! সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এর মতো বোদ্ধারা গ্রিসের আড্ডায় মধ্যমণি থাকতেন। প্লেটোকে কেউ প্রশ্ন করছে, কেউ উত্তর দিচ্ছে, দার্শনিক স্তরে চর্চা হচ্ছে- এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যেতো। বাংলার জীবনের সাথেও আড্ডা জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামরা ছিলেন আড্ডাপ্রিয় মানুষ।
আড্ডার বিষয়বস্তু অনেক রকমের হতে পারে। সাহিত্য-সংস্কৃতি,রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম নানা বিষয় নিয়ে হতে পারে আড্ডা। তবে বলা হয়, যে আড্ডায় যত রং-রূপ-রস এর মানুষ সে আড্ডা তত আকর্ষক। যদিও বাস্তবে বেশিরভাগ দেখা যায়, সাধারণত এক ধরণের বিষয়ে আগ্রহীরা এক সাথে বসে আড্ডা দিতে ভালবাসেন।
মানসম্মত আড্ডা মানুষকে মানবিক, সৃজনশীল, সংবেদনশীল করে। তাই আড্ডাকে আপন করে নেয়া ভুল কিছু নয়।
কিন্তু অতিরিক্ত আড্ডাবাজি, আড্ডা-আসক্তি, বাজে আড্ডা সর্বনাশ ডেকে আনে। এজন্য হয়তো বলা হয়ে থাকে, ‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’ তাই আড্ডার মানুষদের ভালো করে যাচাই করে নেয়া দরকার। আড্ডা-আসক্তি মানুষকে জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে বিমুখ করে দিতে পারে। নিয়ম মেনে না চলা, নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়ার ঘটনা ডেকে আনতে পারে নানান অসুখ-বিসুখ। হীনমন্যতা থেকে আসতে পারে মনোবৈকল্যও।
একই সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মনে রাখতে হবে- কেবল আড্ডাই একজনকে এডিসন, নিউটন, আইনস্টাইন হিসেবে তৈরি করে না, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল বানায় না, আব্রাহাম লিংকন, আলেকজান্ডার হিসেবে গড়ে না, শেক্সপিয়ার, টলস্টয় এর মতো খ্যাতি এনে দেয় না। আমাদের এখানকার রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা লালন-হাছন এর মতো অমরত্বের মূলেও স্রেফ আড্ডা নয়। এর সাথে আরো অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিলে একজন ‘মহান’ হয়ে উঠেন। নিরন্তর সাধনার ফসল হিসেবেই তাঁরা একেকজন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন। তাই আড্ডামাখা জীবনই সেরা জীবন নহে। অহেতুক আড্ডা তো অযথা অপচয় মাত্র।
তাহলে আড্ডা কোন তরিকায় চলতে পারে? কিভাবে আড্ডা থেকে সেরা ফল ঘরে তোলা যায়? এ ব্যাপারে জ্ঞানবান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর কথাগুলো হতে পারে আমাদের জন্য গাইডলাইন। তিনি বলেছেন, “আড্ডা মানেই সৃজনশীলতা। যদি দেখা যায় আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো আয়েশী ভঙ্গিতেই দিচ্ছি, কিন্তু তার পেছনে আমার একটি চিন্তাশীল মন কাজ করছে, তবে সেটিই সৃজনশীল আড্ডা। আর শুধু পরচর্চা, পরনিন্দা, হিন্দি সিনেমা নিয়ে কথা বলা, নিম্নমানের বিষয় নিয়ে ডুবে থাকা, এ আড্ডা শেষ পর্যন্ত কোথাও নিয়ে যায় না মানুষকে। ওগুলো তারাই করে যাদের জীবনে কাজ নেই। উচ্চতর উদ্দেশ্য নেই। আড্ডা তাদের জন্যই সবচেয়ে লাভজনক, যাদের জীবনের সামনে কোন উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর জীবনের সামনে একটা উদ্দেশ্য আছে। তাই আড্ডা তাদের জন্য লাভজনক, প্রয়োজনীয়।”
আসলে আড্ডা যেন এক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এর ক্যাম্পাস বিশ্বজোড়া। সবখানে এই অলিখিত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মানে তো বারান্দায় স্রেফ হাঁটাহাটি কিংবা ক্যাম্পাসে কেবল ছুটোছুটি নয়। ক্লাসরুমে পড়া, পরীক্ষাগারে শেখা থেকেই সফল ছাত্র, সেরা গবেষক বের হয়ে আসতে পারেন। আড্ডা নামক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এমন লেখাপড়ার ফসল তুলতে পারাতেই সার্থকতা। মানে এটিকে জ্ঞানে-গুণে ধনবান হওয়ার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে নেয়া যায়। নয়তো তা কেবলই অপচয়ের ইতিহাস হয়ে পোড়াবে।
লেখক: ফজলুর রহমান। উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
Prev Post
Next Post